২৩ নভেম্বর ২০২৪, শনিবার, ০২:০৬:১০ অপরাহ্ন
জ্বালানি নিরাপত্তায় কয়লায় নজর
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-০৩-২০২৪
জ্বালানি নিরাপত্তায় কয়লায় নজর

সরকারি হিসাবে দেশের প্রায় ২৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার মধ্যে ৫ হাজার ৯০৭ মেগাওয়াট হচ্ছে কয়লাভিত্তিক। এর মধ্যে একমাত্র বড়পুকুরিয়ার ৫২৫ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি চলে সেখানকার খনির কয়লা দিয়ে। বাকি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো আমদানির কয়লার ওপর নির্ভরশীল। প্রতি মাসে বিপুল ডলার ব্যয় করার পরও আমদানি অনিশ্চয়তায় প্রায়ই বন্ধ থাকছে বড় বড় কয়লার বিদ্যুৎকেন্দ্র। ডলার সংকটে চাহিদা অনুযায়ী কয়লা আমদানি করতে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। ফলে কয়লার অভাবে কোনো না কোনো তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের মাটির নিচে পড়ে থাকা কয়লা কাজে লাগাতে জোর প্রচেষ্টা চালাতে যাচ্ছে সরকার।


জানা গেছে, দেশে আবিষ্কৃত খনিগুলো থেকে কয়লা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। এ লক্ষ্যে দেশের পাঁচটি খনির সামগ্রিক চিত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে শিগগিরই উপস্থাপন করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পাওয়া গেলে দ্রুত উত্তোলনে যেতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে জ্বালানি বিভাগ। এ জন্য উন্মুক্ত, ভূগর্ভস্থ কিংবা উভয় পদ্ধতিও কাজে লাগানোর পরিকল্পনা আছে। এ ছাড়াও আন্ডারগ্রাউন্ড কোল গ্যাসিফিকেশন (ইউসিজি) পদ্ধতিও বিবেচনায় রয়েছে।


জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি বাংলাদেশের কয়লাক্ষেত্রের বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাব্য করণীয় শীর্ষক এক সভায় সভাপতিত্ব করেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। সেখানে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশের ৫টি খনিতে ৭ হাজার ৮২৩ মিলিয়ন টন কয়লা মজুদ রয়েছে, যা ২০০ টিসিএফ গ্যাসের মজুদের সমান। এই কয়লা উত্তোলন করতে পারলে অন্তত ৫০ বছরের জ্বালানি নিশ্চিত হবে। বৈঠকে জ্বালানি সংকট সমাধানে কয়লা উত্তোলনে একমত পোষণ করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সবাই। তবে কোন পদ্ধতিতে কয়লা তোলা হবে, সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে।


দেশে গত ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে কয়লা তোলা হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৮ মিলিয়ন টন, আর আমদানি হয় ৬ দশমিক ৮২ মিলিয়ন টন। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে তোলা হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৭৬ মিলিয়ন টন এবং আমদানি হয়েছে ১০ দশমিক ১২ মিলিয়ন টন। এ অবস্থায় ২০৩০ সালে আমদানির পরিমাণ দাঁড়াবে ২৭ দশমিক ২ মিলিয়ন টন এবং ২০৪১ সালে হবে ৭১ দশমিক ২ মিলিয়ন টন। আরও জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ দশমিক ১৪ মিলিয়ন টন কয়লা আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৫৪ কোটি ডলার, ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে খরচ হয়েছে ৭০ কোটি ডলার। পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি করার কারণে বছরে প্রায় ১ কোটি টন কয়লা আমদানির জন্য হাজার কোটি টাকা সংস্থান করতে হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে বাঁচতে নিজস্ব কয়লা তোলায় মনোযোগী হয়েছে সরকার। সরকারের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী অদূর ভবিষ্যতে কয়লা থেকে অন্তত সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হাইড্রোকার্বন ইউনিট বলছে, তাতে বর্তমান কয়লার আন্তর্জাতিক বাজারদর হিসাবে খরচ প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।


জ্বালানি বিভাগের বৈঠকে বড়পুকুরিয়ায় কর্মরত চায়না ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তি ২০২৯ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এতে আরও এক দশমিক ০৮ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন করা যাবে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি সিদ্ধান্ত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- বড়পুকুরিয়ায় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণের লক্ষ্যে ছয় মাসের মধ্যে পরামর্শক নিয়োগ করতে হবে, দীঘিপাড়া খনির কয়লা তোলায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পুনর্বাসন ও নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে, কয়লা তোলার পর খনির জমি কৃষকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার কৌশল নির্ধারণ করতে হবে, জামালগঞ্জ খনি থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড কোল গ্যাসিফিকেশন পদ্ধতিতে কয়লাকে গ্যাসে রূপান্তর ও উত্তোলন বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ ছাড়া ফুলবাড়ী, খালাসপীর খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সব জরিপ সম্পন্ন করে একটি চিত্রবিবরণী প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।


জানা গেছে, বাংলাদেশে আবিষ্কৃত পাঁচটি কয়লা খনির মধ্যে একমাত্র বড়পুকুরিয়ায় ২০০৫ সাল থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। খনিটিতে ৪১০ মিলিয়ন টন কয়লা মজুদ রয়েছে। তবে ২০২৭ সালের পর খনিটি থেকে কয়লা তোলার কোনো অনুমোদিত পরিকল্পনা বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিএমসিএল) নেই। এ কারণে খনিতে কর্মরত চায়না ঠিকাদার এক্সএমসি-সিএমসির সঙ্গে নতুন একটি চুক্তির মাধ্যমে ২০২৯ সাল পর্যন্ত আরও এক দশমিক ০৮ টন কয়লা উত্তোলন করতে চায় বিসিএমসিএল। বৈঠকসূত্রে জানা যায়, মার্কিন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘জন টি-বয়েড’ ইতোমধ্যে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এই খনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলা সম্ভব। ফলে খনি কর্তৃপক্ষ এই পদ্ধতিতে আগ্রহী হয়েছে।


দেশে এখন পর্যন্ত পাঁচটি কয়লা খনি আবিষ্কার হয়েছে। সবগুলোই উত্তরাঞ্চলে। এসব খনিতে ৭ হাজার ৮২৩ মিলিয়ন টন কয়লার মজুদ আছে। জ্বালানি বিভাগের বৈঠকে বলা হয়েছে, কয়লার ২০ শতাংশ উত্তোলনযোগ্য হলেও এর পরিমাণ দাঁড়াবে ১ হাজার ৫৬৪.৬ মিলিয়ন টন। এ পরিমাণ কয়লা ৪০.৬ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সমান জ্বালানি চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম।


দেশের জ্বালানি খাত ক্রমশ আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন ভূতত্ত্ববিদ বদরুল ইমাম। তিনি বলেন, আরও অনেক আগে সরকারের কয়লা তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার ছিল। কয়লা তুলতে গিয়ে স্থানীয় মানুষের সংকটকেও বিবেচনায় রাখতে হবে।


কয়লা খনি এলাকায় সাধারণ মানুষের কৃষিজমি ও বসবাস রয়েছে বলে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকার। তিনি বলেন, সামগ্রিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কয়লা উত্তোলনের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের স্টাডি করা হচ্ছে। সেগুলো প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হবে। তিনি সিদ্ধান্ত দিলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


বিভিন্ন কয়লাক্ষেত্র নিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করা হয়েছে এবং আরও কিছু সমীক্ষা চলছে বলে আমাদের সময়কে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, কয়লা তুলতে গিয়ে আমরা পরিবেশ, পানি, স্থানীয়দের পুনর্বাসন প্রয়োজনীয় সব কিছুই করব। আমরা সামগ্রিক বিষয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করব। তিনি নির্দেশ দিলে আমরা দেশীয় কয়লা উত্তোলন করে ব্যবহার করব।


উল্লেখ্য, দেশের পাঁচটি খনির মধ্যে বড়পুকুরিয়া খনিতে মজুদ আছে প্রায় ৪১০ মিলিয়ন টন কয়লা। উত্তোলনযোগ্য মজুদ ২০০ মিলিয়ন টন। দীঘিপাড়া কয়লাখনির মজুদ ৭০৬ মিলিয়ন টন। উত্তোলনযোগ্য মজুদ ৯০ মিলিয়ন টন। এখানে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে বছরে ৩ মিলিয়ন টন কয়লা তোলা যাবে। রংপুরের খালাসপীরে কয়লার মজুদ আছে ৬৮৫ মিলিয়ন টন। উত্তোলনযোগ্য মজুদ ৮০ মিলিয়ন টন। ফুলবাড়ীতে মজুদের পরিমাণ ৫৭২ মিলিয়ন টন। উত্তোলনযোগ্য মজুদ ৪৭০ মিলিয়ন টন। দেশের সবচেয়ে বড় কয়লাখনি জয়পুরহাটের জামালগঞ্জে। এখানে মজুদ আছে ৫ হাজার ৪৫০ মিলিয়ন টন। তোলা যাবে ১ হাজার ৫ মিলিয়ন টন।


শেয়ার করুন