রাজনীতিতে অনেক কিছুই হয়। ‘তলে তলে’ হয়। ওপরে ওপরেও হয়। বাগাড়ম্বর হয়। বৈরিতা হয়। বৈরীপক্ষের সঙ্গে সখ্য হয়। কূটনীতি হয়। এই সবকিছু মিলেই রাজনীতি। রাজনীতিতে সত্য কথা হয়। মিথ্যাও পরিত্যাজ্য নয়। রাজনীতিতে এসবই স্বীকৃত। এমনকি সেখানে ভাঁড়ামিও হয়। তবে সেই ভাঁড়ামি এলেবেলে ধরনের নয়। তেমন ভাঁড়ামি হাস্যচ্ছলে জনমানসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পৌঁছে দিতে পারে। ঝানু রাজনীতিবিদ (সিজনড পলিটিশিয়ান) ছাড়া কেউ তেমন ভাঁড়ামি করতে পারেন না। করতে গেলে বিষয়টা মাঠে মারা যায়। রাজনীতিক নিজেই তখন হাসির পাত্রে পরিণত হন।
এই যে ‘তলে তলে আপস’ হয়ে যাওয়ার একটা বক্তব্য জনসমক্ষে এল এবং সব মহলে মুখরোচক আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠল, সেই বক্তব্য আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দিয়েছেন এক জনসভায়। আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল। সেই দলের সাধারণ সম্পাদক আর যা কিছুই হোন বা না হোন, দলীয় রাজনৈতিক প্রটোকলে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন। তাঁর বক্তব্য গণ্য না করার কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না। কিন্তু দলের শীর্ষ ব্যক্তি এবং দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বক্তব্যের যদি মৌলিক কোনো পার্থক্য দেখা যায়, তখন কী তাঁর কথা বিশ্বাসযোগ্য হয়?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রে বসে ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘তারা (যুক্তরাষ্ট্র) আরও স্যাংশন দেবে। এটা তাদের ইচ্ছা। দেখি কত স্যাংশন দেয়, কোন পর্যন্ত যায়। আমরাও স্যাংশন দেব।’ এরপর ওবায়দুল কাদেরের ওই বক্তব্যের এক দিন আগে লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কারও মাথা ঘামানোর দরকার নাই।’ অর্থাৎ এ নিয়ে মাথা যা ঘামানোর তিনিই ঘামাবেন, যে কাজটি সব সময়, সব ক্ষেত্রে তাঁকেই করতে হয়।
দেশের এবং দলের শীর্ষ নেতার এই বক্তব্য এবং ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য কি সমার্থক? হতে পারে। না-ও হতে পারে। হতে পারে, কারণ রাজনীতিতে অনেক কিছুই হয়। তবে যেটা হয় না তা হলো, দেশের বর্তমান পরিস্থিতির মতো কোনো পরিস্থিতিতে তলে তলে কোনো আপস হলেও জনসমক্ষে তা প্রকাশ করা হয় না। কারণ ওই আপসরফা নিয়েও অনেক রাজনীতি করার অবকাশ থাকে।
সারা পৃথিবীতে রাজনীতিতে তলে তলে অনেক আপস, সমঝোতা হয়েছে এবং হয়। আমাদের দেশেও হয়েছে। কিন্তু কখনোই তা হুবহু প্রকাশ্যে আসেনি। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ছেঁড়া ছেঁড়াভাবে তা প্রকাশ্যে আনা হয়েছে। এটাও রাজনীতিরই অংশ। কিন্তু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেই প্রথা ভেঙে দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে ভারতকেও সম্পৃক্ত করে এমন বক্তব্য দিয়েছেন, যা কারও কারও জন্য বিব্রতকর হতে পারে।
তা ছাড়া, প্রকাশ্য জনসভায় ঘোষণা দেওয়া তলে তলে আপসের কথা জনমানসে কতটা বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে, সে প্রশ্নও থেকেই গেছে। কারণ বাস্তবতার সঙ্গে ওই বক্তব্যের মিল এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তবে এ কথা বলাই যায় যে তিনি ওই বক্তব্যের মাধ্যমে আমাদের রাজনীতির এক গুণগত পরিবর্তন প্রকাশ্যে আনলেন। সেই পরিবর্তন একটি চিরস্থায়ী ও প্রয়োজনীয় প্রথা ভাঙার পরিবর্তন। তলে তলে আপস বলতে কী বোঝায়, তার একটা ব্যাখ্যা অবশ্য গত বৃহস্পতিবার ওবায়দুল কাদের দিয়েছেন। কিন্তু তা ধোপে টেকার মতো নয়।
আমাদের দেশে এ ধরনের পরিবর্তন শুধু রাজনীতিতে নয়, প্রায় সর্বক্ষেত্রেই হয়েছে। এই তো সেদিন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, দেশের রিজার্ভ নিয়ে ভেতরে-ভেতরে (মানে তলে তলে) কিছু একটা হচ্ছে,
যা আমাদের জানার বাইরে। তিনি এ কথা বলেছেন, কারণ, তাঁর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী দেশে বৈদেশিক মুদ্রার আয়-ব্যয়ের সমীকরণ মিলছে না। একজন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদের এমনটা মনে হওয়ার মতো অবস্থা অবশ্যই একটা বড় পরিবর্তন।
দেশের অর্থনীতিতে এবং আর্থিক খাতে তলে তলে এমন আরও অনেক কিছু হচ্ছে বলে জনবিশ্বাস (পপুলার বিলিভ) আছে। বাস্তবিক অবস্থাও সেই বিশ্বাসের পক্ষেই সাক্ষ্য দেয়। উদাহরণ হিসেবে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং অর্থ পাচারের বিষয় নির্দ্বিধায় উল্লেখ করা যায়। দেশের আর্থিক খাত তো এখন কার্যত লুটেরা এবং অবৈধ অর্থ পাচারকারীদের করায়ত্তে। দ্রব্যমূল্যের কথা আর নতুন করে কীই-বা বলার থাকতে পারে। কিন্তু এ নিয়ে সরকার কিংবা রাজনীতিকদের (বাম ঘরানার রাজনীতিকেরা ছাড়া) খুব বেশি উদ্বিগ্ন বলে কি মনে হয় কারও? বরং তাঁদের কথাবার্তায় নিরুদ্বিগ্ন ভাবই সবার চোখে পড়ে। এ ক্ষেত্রেও কি তাহলে তলে তলে কিছু হচ্ছে! হলে তা প্রকাশ্যে আনা যেতে পারে। তাতে সাধারণ মানুষ অন্তত এসব বিষয়ে সরকারের অবস্থান সম্পর্কে কিছু একটা বুঝতে পারত।
আরেকটি বড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছে ধর্ম, মানে ধর্মের নামে অধর্ম। ধর্মের নাম করে অধর্মের আগাছা সমাজে এত বেড়েছে যে এখন ধর্মাধর্মের প্রভেদ করা, কোনটা ধর্ম আর কোনটা অধর্ম, তা আলাদা করা কঠিনতম কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্ম হয়ে উঠেছে দুর্বলের ওপর প্রবলের নিপীড়নের হাতিয়ার। এই নতুন ধারা যত বেশি সম্প্রসারিত হচ্ছে, সমাজে ততই বাড়ছে দুর্নীতি। পাশাপাশি চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি এখন পদদলিত, বিবর্জিত। বাটপারি-রাহাজানি জাতীয় সংস্কৃতির স্থান দখল করেছে। এসব ব্যাপারে যদি তলে তলে কিছু করা যেত, তাহলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ একটু স্বস্তিতে বাঁচতে পারত। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে যা হচ্ছে ওপরে ওপরেই, মানে প্রকাশ্যেই হচ্ছে। তলে তলে কিছু হওয়ার আশা বোধ হয় দুরাশাই থেকে যাবে।
সব মিলে সমাজে একটা দম বন্ধ করা অবস্থা। তার ওপর তলে তলে আপস প্রসঙ্গ এতটাই সবাইকে আপ্লুত করেছে যে বিএনপির আন্দোলন পড়ে গেছে পেছনে। তবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দেখেন না আন্দোলনের কী কর্মসূচি আসে। দলের অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, ‘আমাদের শক্ত আন্দোলন ছাড়া কোনো উপায় নাই।’ এত দিন বোধ হয় ভেবেছিলেন শক্ত আন্দোলন ছাড়াই সরকার দৌড়ে পালাবে। তেমন কথাবার্তাও জনান্তিকে শুনেছিলাম বৈকি। কিন্তু বাস্তবতা অনুধাবন করে হয়তো তাঁদের বোধোদয় হয়েছে।
এর মধ্যে আবার গত বুধবার ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আয়োজিত পেশাজীবীদের কনভেনশনে মির্জা ফখরুল বললেন, ‘বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার জন্য না, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছি।’ এত সব উল্টা-সিধা কথাবার্তা একটা বিভ্রম সৃষ্টি করছে। জানি না, এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে কী পরিবর্তন আসছে।