রাজধানীর চানখাঁরপুল এম এ আজিজ মার্কেট কমপ্লেক্সে ২০১৭ সালে একটি দোকান বরাদ্দ পান ব্যবসায়ী খায়রুল আলম। চার কিস্তিতে পুরো টাকাও শোধ করেছেন। কিন্তু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পাঁচতলা এই মার্কেটের নির্মাণকাজ দুই বছরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ছয় বছরে উঠেছে মাত্র একতলা। কবে নির্মাণ শেষ হবে, কবে দোকান বুঝে পাবেন, তা জানতে তিনি কয়েক দিন পরপর যান নগর ভবনে।
খায়রুল আলম গত সপ্তাহেও নগর ভবনে গিয়েছিলেন। সেখানে আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘কর্মকর্তাদের কাছে খোঁজ নিতে এসে প্রতিবারই হতাশ হয়ে ফিরতে হয়। ২০১৭ সালে তৎকালীন মেয়র খোকন (মোহাম্মদ সাঈদ খোকন) চানখাঁরপুল মার্কেটের নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন। একতলা ওঠার পর বর্তমানে কাজ বন্ধ। অথচ বর্তমান মেয়র (শেখ ফজলে নূর তাপস) ২০২১ সালে যেসব মার্কেট নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন, সেগুলোর কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। আগের মেয়রের আমলের কাজ এখন কেন বন্ধ, বুঝতে পারছি না।’
খায়রুল আলমের কথার সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শুধু চানখাঁরপুল মার্কেট নয়, সাবেক মেয়র খোকনের সময়ে চলমান ডিএসসিসির ছোট-বড় অন্তত ১০টি প্রকল্পের কাজই বলতে গেলে বন্ধ। এর মধ্যে ৭টিই মার্কেট। ফলে এসব মার্কেটে দোকান বরাদ্দ পাওয়া প্রায় ৫ হাজার ব্যবসায়ী বিপাকে পড়েছেন। দুটি মার্কেট প্রকল্প বাতিল করেছেন বর্তমান মেয়র। অন্য তিন প্রকল্পের মধ্যে দুটির কাজ বন্ধ এবং একটির কাজ নতুন করে শুরু করা হয়েছে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, সাবেক ও বর্তমান মেয়রের মধ্যে বিরোধের ফল ভোগ করছেন তাঁরা। ২০২০ সালের মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন এবং পরবর্তী সময়ে দুটি মার্কেটের নকশা বহির্ভূত দোকান উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন বিরোধিতায় নেমেছিলেন মেয়র তাপসের। এরই জেরে হয়তো কাজ বন্ধ। তবে মেয়র তাপসের জনসংযোগ কর্মকর্তা বলেছেন, এমন কোনো বিষয় নেই।
ডিএসসিসি সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে চানখাঁরপুল মোড়ে ৩৮ দশমিক ৬৪ কাঠা জমিতে দুটি বেসমেন্টসহ পাঁচতলা মার্কেট নির্মাণ কাজ শুরু করে ডিএসসিসি। বরাদ্দ দেওয়া হয় ২৭৭টি দোকান। সাঈদ খোকন মেয়রের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় নির্মাণকাজ যে অবস্থায় ছিল, এখনো সেই একতলাতেই রয়ে গেছে।
দোকান বরাদ্দ পাওয়া ব্যবসায়ীরা সাবেক মেয়রের আমলে দুই কিস্তি এবং বর্তমান মেয়রের আমলে বাকি দুই কিস্তির টাকা শোধ করেছেন। কিন্তু নির্মাণকাজ আর শুরু হয়নি। এ নিয়ে ওই মার্কেটে দোকান বরাদ্দ পাওয়া এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, টাকা শোধের পরও কাজ না ধরায় তাঁরা হতাশ।
সাঈদ খোকনের সময়ে শুরু হয়ে বর্তমানে কাজ বন্ধ থাকা কাপ্তান বাজার মুরগিপট্টি মার্কেটে ১৬৮টি দোকান বরাদ্দ পেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। কিস্তিও দিয়েছেন। এ ছাড়া সিদ্দিকবাজারে ৪১৯টি দোকান, ঢাকেশ্বরী রোড সাইড মার্কেটের ২৩৬টি, যাত্রাবাড়ী পাইকারি আড়তে ১ হাজার ২৬০টি, ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেটে ৮৫২টি এবং গুলিস্তান ট্রেড সেন্টারে ১ হাজার ৫০০ দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয় সাবেক মেয়র খোকনের সময়ে।
এসব মার্কেটের নির্মাণকাজও বন্ধ রয়েছে। খোকনের সময়ে নেওয়া নিউমার্কেটে ১৭৮টি দোকান এবং পলাশী রোড সাইড মার্কেট প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে। পান্থকুঞ্জ পার্ক প্রকল্প এবং কাপ্তানবাজার আধুনিক জবাইখানা প্রকল্পের কাজও বন্ধ। ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলছে, পান্থকুঞ্জ পার্কের কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০১৭ সালে। সেখানে কোনো কাজ না করেই প্রায় ৯০ লাখ টাকা বিল তুলে নিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
ডিএসসিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, সাবেক মেয়র খোকন ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ওসমানী উদ্যানে ‘গোস্যা নিবারণী পার্ক’ প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। তবে কাজ আর এগোয়নি। বর্তমানে টিন দিয়ে ঘেরা উদ্যানটির বিভিন্ন অংশে উন্নয়নকাজের কংক্রিট ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। আগাছা, ঝোপঝাড়ের কারণে মানুষ এই উদ্যান ব্যবহার করতে পারছে না। সম্প্রতি সেখানে নতুন করে কাজ শুরু হয়েছে বলে দাবি ডিএসসিসির।
ডিএসসিসি সূত্র জানায়, বর্তমান মেয়রের সময়ে নেওয়া প্রকল্প একতলা বেসমেন্টসহ পাঁচতলা আজিমপুর আধুনিক শপিং সেন্টারের নির্মাণকাজ সম্প্রতি শেষ হয়েছে। ২০২১ সালের মার্চে এটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল। এ ছাড়া চলতি বছরের শুরুতে মেরাদিয়া কাঁচাবাজার ও শপিং সেন্টারের নির্মাণকাজ শুরু হয়। দ্রুতগতিতে চলা এই প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ডিএসসিসি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মনোনয়নের সময় শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে সাঈদ খোকনের দূরত্ব তৈরি হয়। মনোনয়নবঞ্চিত খোকন দলীয় মেয়র প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামেননি। তাপস মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ফুলবাড়িয়া এলাকায় দুটি মার্কেটের নকশাবহির্ভূত দোকান উচ্ছেদে ডিএসসিসি অভিযান চালালে বিরোধ প্রকাশ্য হয়।
উচ্ছেদের পক্ষে-বিপক্ষে পাল্টাপাল্টি মিছিল-মানববন্ধন হয়। একপর্যায়ে সাঈদ খোকন সংবাদ সম্মেলন করে নতুন মেয়রের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। দুজনেই বাগ্যুদ্ধে জড়ান। পরে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী মহল তাঁদের শান্ত করে। অনেকের ধারণা, এরই প্রভাব হয়তো পড়েছে সাবেক মেয়রের নেওয়া প্রকল্পগুলোতে।
কাজ বন্ধ থাকা প্রকল্পগুলোর বিষয়ে কথা বলতে ডিএসসিসির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের মোবাইলে ফোন করলে তিনি ধরেননি। পরে পরিচয় দিয়ে এসএমএস পাঠালে তিনি ফিরতি এসএমএসে জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। পরে যোগাযোগ করলে জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের বলেন, সাবেক মেয়রের কাজ বর্তমান মেয়র বন্ধ রেখেছেন, এমন কোনো বিষয় নেই। ইতিমধ্যে ওসমানী উদ্যানের কাজ নতুন করে শুরু করা হয়েছে।