২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৩:৫৫:৩২ অপরাহ্ন
সাইবার দুনিয়ায় বেপরোয়া সাত ধরনের অপরাধী চক্র
  • আপডেট করা হয়েছে : ২১-১০-২০২৩
সাইবার দুনিয়ায় বেপরোয়া সাত ধরনের অপরাধী চক্র

ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। বাড়ছে নতুন নতুন সাইবার অপরাধী। এদের খপ্পরে পড়ে আর্থিক ক্ষতিসহ নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন অনলাইন ব্যবহারকারীরা। সাইবার অপরাধে বেশি জড়াচ্ছে তরুণরা। আর ভুক্তভোগীর মধ্যেও তরুণ-তরুণীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।


বিশ্লেষকরা বলছেন, সাইবার জগতে অন্তত সাত ধরনের অপরাধী চক্র বেশি বেপরোয়া। এরমধ্যে অপহরণকারী চক্র, হানি ট্র্যাপ গ্যাং, জঙ্গি, প্রতারক, স্ক্রেমিং, বুলিং ও হ্যাকার চক্র অন্যতম। এদের খপ্পরে পড়ে কেউ জড়াচ্ছেন উগ্রবাদে, কেউ হারাচ্ছেন সর্বস্ব, আর কেউ বেছে নিচ্ছেন আত্মহননের পথ।


২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর চালু হওয়া পুলিশের ‘সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ উইংয়ের তথ্যমতে, শুরু থেকে ২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ উইংয়ে ৩১ হাজার ১৭৮টি অভিযোগ এসেছে। ফেক আইডি, আইডি হ্যাক, ব্ল্যাকমেইলিং, মোবাইলে হয়রানি, আপত্তিকর কনটেন্ট ছড়ানো এবং অন্যান্য বিষয়ে এসব অভিযোগ এসেছে।


সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৮ সালে সাইবার অপরাধের মধ্যে অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার হার ছিল ৮ দশমিক ২৭ শতাংশ। ২০২৩ সালে এ হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ দশমিক ৬৪ শতাংশে। অনলাইনে এসএমএস পাঠিয়ে হুমকির হার ছিল ২০১৮ সালে ১৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ২০২৩ সালে এ হার দাঁড়িয়েছে ১৫ দশমিক ৪৭ শতাংশে। ২০১৮ সালে পর্নোগ্রাফি ব্যবহার করে হয়রানির হার ছিল ২ দশমিক ২৫ শতাংশ। ২০২৩ এ হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ১২ শতাংশে। তবে এসব অপরাধের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে নিত্যনতুন অপরাধ।


অপহরণ চক্র : অপহরণকারীদের একেকটি চক্রে একাধিক তরুণী কাজ করেন। তারা টার্গেট ব্যক্তিকে সম্পর্কের টোপে ফেলে ডেকে নিয়ে যান। এরপর কোনো বাসায় আটকে আপত্তিকর ভিডিও তুলে জিম্মি করা হয়। এসব ভিডিও স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে আদায় করা হয় মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ। সম্প্রতি মিরপুর ২ নম্বর এলাকা থেকে একজন ভুক্তভোগী এবং রামপুরা এলাকা থেকে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, শুধু রাজধানীতেই অন্তত ১০টি অপহরণ চক্র সক্রিয় রয়েছে। এরমধ্যে তিনটির বেশি চক্রকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে।


জঙ্গি : আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে উগ্রবাদীরা (জঙ্গি) এখন ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ খুলে আকৃষ্ট করছে অনলাইন ব্যবহারকারীদের অনেককেই। সম্প্রতি নতুন জঙ্গি সংগঠন ইমাম মাহমুদের কাফেলা, তাওহিদুল উলুহিয়্যার ১৫ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে সদস্য সংগ্রহ, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্নভাবে তৎপরতা চালিয়ে আসছিল তারা।


হানিট্রাপ গ্যাং : হানি ট্র্যাপ গ্যাং মূলত সুন্দরী তরুণীদের দিয়ে ভিডিও কলের মাধ্যমে প্রতারণার ফাঁদ পাতে। অচেনা নম্বর থেকে কারও মোবাইলে আসা ভিডিও কল রিসিভ করতেই ভেসে ওঠে নগ্ন তরুণীর ভিডিও। অপর পাশ থেকে স্ক্রিনরেকর্ড করে ১০-২০ সেকেন্ডের মধ্যেই কলটি কেটে দেওয়া হয়। এরপর ভিডিও এডিট করে অর্থ দাবি করে হুমকি দেওয়া হয়। দাবির টাকা না দিলে আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। মান-সম্মানের ভয়ে অনেকেই নীরবে অর্থকড়ি দিয়ে দেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থও হন না। আবার কখনো গ্যাংয়ের তরুণীরা অনলাইন চ্যাটিংয়ে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এমনকি রাজনীতিবিদদের একই কায়দায় ফাঁদে ফেলে। সূত্র জানিয়েছে, হানি ট্র্যাপ গ্যাং মূলত পাশের দেশ থেকে পরিচালনা করা হয়। এ দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় তাদের এজেন্ট রয়েছে। এ চক্রের ফাঁদে পড়ে গত দেড় বছরে শতাধিক ধনাঢ্য ব্যক্তি লাখ লাখ টাকা খুইয়েছেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।


প্রতারক : চাকরি দেওয়ার মিথ্যা আশ্বাস, ঋণ দেওয়া, পণ্য কেনাবেচা, লটারিসহ লোভনীয় ভিন্ন ভিন্ন টোপ দিয়ে অনলাইন ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে কৌশলে অর্থকড়ি হাতিয়ে নিচ্ছে এ চক্র। রাজধানীতে এ ধরনের ৫শর বেশি প্রতারক সক্রিয় রয়েছে। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র‌্যাব ২০০৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬ হাজারের বেশি প্রতারককে গ্রেফতার করেছে।


সাইবার বুলিং : সাইবার বুলিং হচ্ছে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে উত্ত্যক্ত করা। সাইবার স্পেসে নারীরাই বেশি বুলিংয়ের শিকার হন। সাইবার অপরাধীরা বিভিন্ন তরুণী কিংবা নারীর ইনবক্সে নোংরা এসএমএস, অশ্লীল ছবি, ভিডিও পাঠিয়ে দিয়ে হয়রানি করে থাকে। সাইবার বুলিংয়ের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় ভুয়া আইডি ব্যবহার করা হয়। যে কারণে অপরাধীকে সহজে শনাক্ত করা যায় না। সিসিএ ফাউন্ডেশনের এক গবেষণা থেকে জানা গেছে, সাইবার অপরাধের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীদের ৫০ দশমিক ২৭ শতাংশই নানাভাবে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে।


ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড স্কিমিং : ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড স্কিমিংয়ের মাধ্যমেও অর্থকড়ি হাতিয়ে নিচ্ছে অপরাধ চক্র। সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্ক্রিমার যন্ত্রের মাধ্যমে কার্ড স্কিমিং করা হয়। তথ্য চুরি করে সেই তথ্য দিয়ে কৌশলে টার্গেট ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট খালি করে দেওয়া হয়।


হ্যাকার : হ্যাকিং হলো কম্পিউটার কিংবা ডিজিটাল ডিভাইসকে অবৈধভাবে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া। বিভিন্ন ওয়েবসাইট, কম্পিউটার হ্যাক করা হয়। সামাজিক মাধ্যমে আইডি, ইমেইল, অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে টাকা দাবি করে হ্যাকাররা। এছাড়া ডিজিটাল লেনদেন মাধ্যম বিকাশ হ্যাক করেও টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়। প্রবাসীদের ইমু আইডি হ্যাক করে একটি চক্র নানা কৌশলে তাদের স্বজনদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে।


সাইবার বিশ্লেষকরা বলছেন, সাইবার স্পেস ব্যবহার করে অপরাধে প্রতিনিয়ত মামলা হচ্ছে, গ্রেফতারও হচ্ছেন অপরাধীরা। তবু সাইবার অপরাধীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কুলিয়ে উঠতে পারছে না। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাসুদ বলেন, সাইবার অপরাধীরা ভিন্ন ভিন্ন কৌশলে প্রতারণা করে থাকে। সাইবার অপরাধীরা যতটা গ্রেফতার হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রতারণার ঘটনা ঘটাচ্ছে। অনলাইন প্রতারকদের খপ্পর থেকে মুক্ত থাকতে হলে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।


সিটিটিসি প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ভার্চুয়াল জগতে ২৪ ঘণ্টা নজরদারি চলছে। জঙ্গি, অপরাধীরা এখন সাইবার স্পেসেও নিরাপদ নয়। অনলাইনে জঙ্গিবাদের প্রচার-প্রচারণাও এখন আর জোরালো নয়। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধীদের রুখতে প্রতিনিয়ত সাইবার প্যাট্রোলিং চালিয়ে যাচ্ছে। ব্যবহারকারীদের সচেতনতার সঙ্গে অনলাইন ব্যবহার করতে হবে। আর কেউ কখনো অপরাধীদের পাতা ফাঁদে পড়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হতে হবে। সচেতনতার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।


শেয়ার করুন