একসময় বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি পণ্য ছিল চা। পাটের পরেই ছিল চায়ের অবস্থান। এখন সেই চিত্র আর নেই। সময়ের পরিক্রমায় রপ্তানিকারক দেশটি পরিণত হয়েছে চায়ের বড় আমদানিকারকে। বাগানগুলোয় রেকর্ড উৎপাদনেও পানীয় পণ্যটির আমদানি কমছে না, যদিও ঠিকই কমছে রপ্তানি।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ব্রিটিশ শাসকদের অনেক কসরতে চা পান করা শেখা এই দেশের মানুষ এখন চায়ের প্রতি ভালোই অভ্যস্ত। শুধু দেশীয় চা নয়, ভালো মানের বিদেশি চায়েও আগ্রহ বেড়েছে একশ্রেণির মানুষের। সর্বোপরি চায়ের ভোগ এতটাই বেড়েছে যে দেশে উৎপাদন কয়েক গুণ বাড়ার পরও চাহিদা মিটছে না তাতে। ফলে আমদানি করে বাকি চাহিদা মেটাতে হচ্ছে।
পরিসংখ্যান বলছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ চা রপ্তানি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে। বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে কমেছে চায়ের রপ্তানি। সে বছর ২১ লাখ ৭ হাজার কেজি চা রপ্তানি হয়েছিল। এরপর ২০২১ সালে রপ্তানির পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৮ হাজার কেজি। পরের বছর ২০২২ সালে ৭ লাখ ৮ হাজার কেজি এবং চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৫ লাখ ৩০ হাজার কেজি চা রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।
ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যাচ্ছে আমদানিতে। ২০২০ সালে দেশে ৬ লাখ ৮০ হাজার কেজি চা আমদানি করা হয়েছিল। এরপর তা ক্রমে বেড়ে ২০২১ সালে ৭ লাখ ৪০ হাজার কেজি এবং ২০২২ সালে ১০ লাখ কেজিতে দাঁড়ায়। আর চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ২ লাখ ৯০ কেজি চা আমদানির তথ্য পাওয়া গেছে।
রপ্তানি কমে যাওয়ার জন্য উচ্চ মানের চা উৎপাদিত না হওয়াকে দায়ী করেছেন বিশ্লেষকেরা। চায়ের রপ্তানি কমার পেছনে তিনটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেছেন কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান। কারণগুলো হচ্ছে চাহিদা বৃদ্ধি, চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উৎপাদন না বাড়া এবং ভালো মানের চা উৎপাদন কম হওয়া।
আজকের পত্রিকাকে জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, ‘একদিকে আমাদের চাহিদা বেড়েছে, অন্যদিকে উৎপাদন বাড়লেও চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়েনি। আমদানি নিরুৎসাহিত করতে চায়ের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করা আছে।
তারপরও ভালো মানের চা আমদানি হয়। তবে এর ভোক্তা সাধারণ মানুষ নয়। এটা খুবই উচ্চ মানের চা, এর ভোক্তা উচ্চ স্তরের।’
চা শিল্পের সোনালি অতীত বাংলাদেশে ১৮৪০ সালে প্রথম চায়ের চাষাবাদ শুরু হয়। কিন্তু তখন খুব একটা সফলতা পাওয়া যায়নি। পরে ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিক চা-বাগান গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে চা হয়ে ওঠে দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি পণ্য।
১৯৪৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বছরে ১৮ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হতো, এর মধ্যে রপ্তানি হতো ১৫ মিলিয়ন কেজি। তার মানে, এ দেশের মানুষ তখনো পুরো চা পানে অভ্যস্ত না হওয়ায় উৎপাদিত চায়ের বড় অংশই রপ্তানি হতো। ১৯৭০ সালে এসে বছরে চায়ের উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩১ মিলিয়ন কেজিতে। তখনো চায়ের একটা বড় অংশই রপ্তানি হতো।
উৎপাদন ও ভোগের চিত্র
উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে চা চাষ পরবর্তী সময়ে ভালোই বিস্তার লাভ করে এ দেশে। বর্তমানে দেশে ১৬৭টি চা-বাগান উৎপাদনে আছে। এসব বাগানে ২০২১ সালে রেকর্ড ৯ কোটি ৬৫ লাখ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। এ ছাড়া ২০২০ সালে ৮ কোটি ৬৩ লাখ ৯০ হাজার কেজি, ২০২২ সালে ৯ কোটি ৩৮ লাখ ৩০ হাজার কেজি এবং সর্বশেষ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ২ কোটি ৬৪ লাখ ৪০ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে দেশে।
উৎপাদনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভোগও। বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে বলেন, এখন বছরে ৯৬ মিলিয়ন কেজির বেশি চা উৎপাদিত হয়। আর বছরে ১০০ মিলিয়ন কেজি চা দেশের মানুষই পান করে।
সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানির যে সক্ষমতা হওয়ার কথা ছিল, সেটি অর্জন করা যায়নি। অভ্যন্তরীণ বাজারে আমরা যে চা পান করি, বৈশ্বিক বাজারে তার চাহিদা কম। ভারতের আসাম কিংবা শ্রীলঙ্কা যে মানের চা উৎপাদন করে, তা আমাদের এখানে খুব কমই হয়ে থাকে। রপ্তানি বাজার উপযোগী চা আমরা উৎপাদন করতে পারছি না।’ তবে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা পূরণ করাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সীমিত আকারে রপ্তানিতে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।
আমদানি নিয়ন্ত্রণে উচ্চ শুল্ক
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র জানায়, বর্তমানে চা আমদানিতে ৮৯ দশমিক ৩২ শতাংশ শুল্ক নির্ধারিত আছে। এর মধ্যে আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ, সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ, নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ৩ শতাংশ ও অগ্রিম কর ৫ শতাংশ। বলা যায়, চা আমদানি বন্ধ করতেই এত বেশি হারের শুল্ক স্তর।
এনবিআর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা দিতে এনবিআর বিভিন্ন পণ্যের আমদানির ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করে।সংস্থাটি চাইলেও কোনো পণ্যের আমদানি বন্ধ করে দিতে পারে না। এর এখতিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। তবে আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্কহার বাড়াতে পারে। দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি পণ্য হিসেবে বর্তমানে চায়ের আমদানিকে দুঃখজনক হিসেবে দেখছেন তাঁরা।
তবে উচ্চ স্তরের ক্রেতাদের জন্যই চা আমদানি করতে হয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম, এনডিসি, পিএসসি। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বলতে গেলে সবই কনজিউম (ভোগ) হয়ে যায়। একসময় যখন উৎপাদন ছিল ৩০ মিলিয়ন, তখন ২০ মিলিয়নই রপ্তানি হতো।
তখন দেশের মানুষ খুব একটা চা পান করত না এবং খাওয়ার সক্ষমতাও ছিল না। ধীরে ধীরে উৎপাদন বাড়তে থাকে, সেই সঙ্গে বাড়ে চাহিদাও। ২০২১ সালে রেকর্ড ৯৬ মিলিয়ন উৎপাদিত হওয়ার পরও কিন্তু বেশি রপ্তানি করতে পারিনি। এ ছাড়া উচ্চ স্তরের কিছু চায়ের ক্রেতা বাংলাদেশে আছে, তাদের জন্যও কিছু পরিমাণে আমদানি করতে হয়।’ তিনি বলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে ১৪০ মিলিয়ন উৎপাদনের লক্ষ্য রয়েছে। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমরা যদি মানসম্মত চা উৎপাদন করতে না পারি, তাহলে বাজার হারাতে হবে।’