২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১১:১১:১৩ অপরাহ্ন
চাপে থাকা অর্থনীতিতে স্বস্তির আভাস
  • আপডেট করা হয়েছে : ২১-১০-২০২৩
চাপে থাকা অর্থনীতিতে স্বস্তির আভাস

সব ধরনের জল্পনা-কল্পনা ও অনিশ্চয়তার অবসান ঘটিয়ে আইএমএফের কাছ থেকে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সংস্থাটি ঋণ প্রদানের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ঘোষণায় বহির্বিশ্বে আবারও বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।


ইতোমধ্যে সার্কভুক্ত সদস্য রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের ঋণের কিস্তির টাকা আটকে দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ। ওইসব দেশের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবেই সংস্থাটির কাছ থেকে ঋণের কিস্তি পাবে। এ দেশের উন্নয়নে পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে আইএমএফ।


এ অবস্থায় বড় চার উন্নয়ন সহযোগী বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক, এশীয় ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ও এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকসহ অন্য উন্নয়ন সহযোগীরাও বিনিয়োগ ও অবকাঠামো খাতে ঋণ সহায়তা অব্যাহত রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে করে দীর্ঘদিন ধরে চাপে থাকা অর্থনীতিতে স্বস্তির আভাস দেখা দিয়েছে।


সূত্রমতে, আন্তর্জাতিক নানা সংকটের কারণে দেশের অর্থনীতি এখন কঠিন সময় পার করেছে। সামষ্টিক অর্থনীতির বেশিরভাগ সূচক এখন নি¤œœমুখী। বিশেষ করে রপ্তানি ও রেমিটেন্স কমে যাওয়ায় অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। একদিকে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে প্রতিনিয়ত কমছে রিজার্ভ। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সব ধরনের ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে দেশে। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে ভোগ্যপণ্যের দাম।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংকটের জন্য বাংলাদেশ দায়ী নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে সৃষ্ট সংকট এখন বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবলভাবে চেপে বসেছে। নতুন করে ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ আরেকটি সংকট তৈরি করবে বিশ্বজুড়ে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় আইএমএফের কাছ থেকে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি প্রায় ৭০ কোটি ডলার পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। প্রথম কিস্তির চেয়ে যা প্রায় ২০ কোটি ডলার বেশি। ঋণের এই অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভকে শক্তিশালী করবে।


এছাড়া আগামী চার বছরে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে আরও ১১০০ কোটি ডলার। আর সামনে বড় দিনের উৎসব ঘিরে বাড়বে পোশাকের রপ্তানি। একইসঙ্গে মার্চে শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। ওই মাস ঘিরে ঈদের প্রস্তুতি শুরু হবে আর একমাস পর থেকেই। ফলে প্রবাসীদের কাছ আবার রেমিটেন্স আসা বাড়বে। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচন শেষে নতুন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পাবে। স্থবির হয়ে পড়ে থাকা বিনিয়োগে আবার  গতি ফিরে আসার সুযোগ তৈরি হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। সবমিলিয়ে নতুন বছরের শুরুতে ঘুরে দাঁড়াবে দেশের অর্থনীতি। আর এক্ষেত্রে আইএমএফের কাছ থেকে ধারাবাহিকভাবে ঋণ প্রাপ্তি একটি বড় সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে।


এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, আইএমএফের কাছ থেকে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার বিষয়টি এখন প্রায় নিশ্চিত। বিশ্বমন্দার এই সময়েও বাংলাদেশের অর্থনীতি যে সঠিক পথে রয়েছে আইএমএফ তা দেখিয়ে দিল। সব ধরনের শর্ত পরিপালন করে তাদের ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়া খুব জরুরি ছিল। এতে করে অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীও বাংলাদেশে ঋণ সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে বলে আশা করছি। তিনি বলেন, আইএমএফের পরবর্তী কিস্তিগুলো পাওয়ার ব্যাপারে শর্তগুলো পূরণ করতে হবে। দেশের স্বার্থে আইএমএফের শর্ত পূরণ হওয়া প্রয়োজন।


আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ার বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বিশ্বব্যাংক। তবে এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া না গেলেও সম্প্রতি সংস্থাটির বাংলাদেশে কর্মরত এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, আইএমএফকে অনুসরণ করেই বিশ্বব্যাংক তাদের ঋণ কার্যক্রম বাড়িয়ে থাকে। এ কারণে আইএমএফ স্টাফ মিশনের বাংলাদেশ সফর এবং তাদের প্রতিবেদন বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য ঋণদান সংস্থাগুলো পর্যবেক্ষণ করে থাকে।


এদিকে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ঋণদাতা সংস্থা বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অনুকূলে এবার বাজেট সহায়তা দ্বিগুণ করার ইঙ্গিত দিয়েছে। এছাড়া এশীয় ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ও এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকসহ অন্য উন্নয়ন সহযোগীরাও বিনিয়োগ ও অবকাঠামো খাতে ঋণ সহায়তা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। সদ্য শেষ হওয়া বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের বার্ষিক সভায় যোগদান শেষে মরক্কো থেকে দেশে ফিরেছেন অর্থসচিব ড. খায়রুজ্জামান মজুমদার ও বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের কাছে এবার ঋণ সহায়তা বাড়ানোর অনুরোধ করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, সংস্থা দুটি বাংলাদেশের ঋণ সহায়তা কার্যক্রম বাড়াবে।


বড়দিন ও ঈদ উৎসব সামনে রেখে রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়বে ॥ ডিসেম্বরের বড়দিন উৎসব সামনে রেখে সারাবিশ্বে পোশাক রপ্তানি বাড়বে। ইতোমধ্যে পোশাকের অর্ডার বাড়ছে বলে জানিয়েছে পোশাক খাত মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। রপ্তানি বাড়ায় বৈদেশিক মুদ্রা অর্থাৎ আরও বেশি ডলার আসার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এছাড়া আগামী মার্চে রোজা শুরু হবে। রোজা এবং ঈদ সামনে রেখে প্রবাসীরা মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে বেশি বেশি রেমিটেন্স পাঠাবেন। এতে করে রিজার্ভ বাড়বে। অর্থনীতিতে এখন ডলার সংকট সবচয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। আশা করা হচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে ডলার সংকট কেটে যাবে।


বাংলাদেশের পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান জানান, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেই রপ্তানিকারকরা উৎপাদন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন। বড় দিন সামনে রেখে এ সময়টাতে রপ্তানি অর্ডার বাড়ে। গার্মেন্টসগুলোতে এখন পুরোদমে কাজকর্ম চলছে। আশা করা হচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে রপ্তানি আয় বাড়বে।  এছাড়া মার্চে শুরু হরে রমজান মাস। ওই মাস ঘিরে পাইকারি ও উৎপাদনকারী ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। এই ঈদকে ঘিরে কয়েক মাস আগে থেকে কয়েক লাখ কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগ হয় দেশে।  ফলে অর্থনীতির সকল খাতে টাকার প্রবাহ বেড়ে যায়। শুধু তাই নয়, রমজান মাসের শুরু থেকেই প্রবাসীরা আপনজনদের কাছে ডলার পাঠাতে শুরু করেন। ফলে সামনের দিনগুলোতে দেশে বিদেশী মুদ্রা ডলারের জোগান আরও বাড়বে।


উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে আসবে ১১০০ কোটি ডলার ॥ আগামী চার বছরে আইএমএফসহ অন্য চার উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকে প্রায় ১১০০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা আসবে। ইতোমধ্যে আইএমএফের বোর্ড সভায় বাংলাদেশের অনুকূলে ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। যার প্রথম কিস্তি ৪৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার পেয়েছে সরকার। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় কিস্তি বাবদ আরও প্রায় ৭০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়া যাবে। এছাড়া আগামী চার বছরে বিশ্বব্যাংক থেকে ১৭৫ কোটি ডলার, এডিবি থেকে ২০০ কোটি ডলার, জাইকা ও এশিয়ান ইনফ্রাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকসহ অন্যদের কাছ থেকে প্রায় ২১২ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা পাওয়া যাবে। এতে করে এই পাঁচ উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকেই মিলবে প্রায় ১১০০ কোটি ডলার। এর পাশাপাশি অন্যান্য সংস্থার কাছ থেকেও ঋণ সহায়তা পাওয়া যাবে বলে আশা করছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর ৫০ বছর উদযাপন করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে সংস্থার পক্ষ থেকে ৫০ কোটি ডলারের বাজেট সহায়তা দেওয়া হবে। এছাড়া ভবিষ্যতেও ঋণ সহায়তা বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।


শেয়ার করুন