২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ০৪:৪৭:৩৭ অপরাহ্ন
যশোরে সোনা জব্দের ৬০ মামলার অর্ধেক ঝুলছে
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-১০-২০২৩
যশোরে সোনা জব্দের ৬০ মামলার অর্ধেক ঝুলছে

যশোরের শার্শা সীমান্ত থেকে ২০১৮ সালের ৯ আগস্ট ৭২ কেজি ৪৫০ গ্রাম ওজনের ৬২৪টি সোনার বার জব্দ করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এটিই ওই অঞ্চলে গত কয়েক বছরে চোরাচালানের সময় জব্দ হওয়া সবচেয়ে বেশি সোনা। ওই সময় মহিউদ্দিন নামের এক চোরাকারবারিকে আটক করে শিকারপুর বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা।


এ ঘটনায় হওয়া মামলা তদন্ত করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মহিউদ্দিনসহ নয়জনের নামে অভিযোগপত্র দেয়। প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সিনিয়র স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে মামলাটির। এর মধ্যে মহিউদ্দিনসহ চার আসামি জামিনে রয়েছেন।


বাকি পাঁচ আসামি পলাতক। আবার চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি শার্শার পাঁচভুলোট গ্রামের নয়কোনা বটতলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে মোটরসাইকেল আরোহী আব্দুর রাজ্জাককে আটক করে অগ্রভুলোট বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা। এ সময় তাঁর স্বীকারোক্তিতে মোটরসাইকেলের চেসিসের নিচে বিশেষ কৌশলে লুকিয়ে রাখা ৭ কেজি ৩৩৭ গ্রামের ৬৩টি সোনার বার জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় শার্শা থানায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত শেষে রাজ্জাককে অভিযুক্ত করে গত ২৩ সেপ্টেম্বর যশোর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। তবে বাহক ধরা পড়লেও চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত মূল ব্যক্তিরা অধরা।


সংশ্লিষ্ট আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত এক দশকে সোনা জব্দের এমন অনেক ঘটনায় অন্তত ৬০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলার প্রায় অর্ধেকের রায় হয়েছে। বাকি অর্ধেকের বেশি বিচারাধীন। বেশির ভাগ আসামি জামিনে রয়েছেন। মামলাগুলোর তদন্তেও তেমন অগ্রগতি নেই। অন্যদিকে যেসব মামলায় বিচার হয়েছে, সেগুলোতে সাজা পাওয়া প্রত্যেকেই সোনা বহনকারী। মূল হোতারা থেকে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।


যশোর বিজিবি এবং বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সূত্রে জানা যায়, গত এক দশকে দেড় হাজার কেজি সোনা জব্দ হয়েছে সীমান্তবর্তী এই জেলা থেকে। এর মধ্যে গত চার বছরেই জব্দ হয়েছে আড়াই শ কেজি। চলতি বছরের ছয় মাস না-যেতেই ৩৪ কেজির বেশি সোনা জব্দ হয়েছে। কখনো গাড়িতে বিশেষ কায়দায়, কখনো পেটের ভেতর বা পায়ুপথে, নারীদের গোপনাঙ্গে, স্যান্ডেল-জুতার ভেতরে নানা কৌশলে পাচারের সময় এসব সোনা জব্দ করা হয়। অনেক সময় পরিত্যক্ত অবস্থায়ও সোনা উদ্ধার করা হয়েছে। 


বিচারে কেন ধীরগতি

মামলার বিভিন্ন ধাপে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চোরাচালানের সোনা জব্দ হওয়ার পর মামলায় স্থানীয়দের সাক্ষী করা হয়। বেশির ভাগ মামলায়ই এসব সাক্ষী নিয়মিত আদালতে হাজিরা দেন না। এতে মামলার অভিযোগপত্র গঠনেও দেরি হয়। বিচার শুরুর পর লম্বা বিরতি দিয়ে শুনানির তারিখ ধার্য হয়। সাক্ষীকে হাজির করাও কঠিন হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তাদের (আইও) সাক্ষ্য পেতে সবচেয়ে দেরি হয়। বিশেষ করে বদলি হয়ে গেলে তাঁদের সাক্ষ্য পেতে বছরের পর বছর লেগে যায়।


এ বিষয়ে যশোরের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এম ইদ্রীস আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সাক্ষীর অভাবে এসব মামলার কাজ শেষ করতে বিলম্ব হচ্ছে। অনেক সময় তদন্ত কর্মকর্তারা প্রতিবেদন জমা দিতে না পারার কারণে বিচারে এই ধীরগতি।’ তবে তিনি বলেন, সোনা চোরাচালানসহ সব পুরোনো মামলার কাজ শেষ করার উদ্যোগ নিয়েছে বিচার বিভাগ। দ্রুতই সোনা চোরাচালান মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ করে কাজ শেষ করবে।


হোতারা অধরা

চোরাচালান প্রতিরোধে কাজ করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, একটি সোনার বার ভারতে পাচারে বিভিন্নভাবে চক্রের অন্তত ৩০-৪০ জন কাজ করেন। কেউ বাহক, কেউ লাইনম্যান, কেউবা ইনফরমার। আবার কেউ কেউ বাহক, লাইনম্যান ও ইনফরমারের ওপর গতিবিধি অনুসরণের কাজ করেন। তবে তাঁর আগের বা পরেরজন কে, তা তাঁরা জানতে পারেন না। তেমনি মূল হোতা কারা তাও তাঁদের জানতে দেওয়া হয় না। তাঁরা শুধু নির্দিষ্ট সময় তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন এবং তাঁদের ভাগের টাকা যথাযথভাবে বুঝে নেন। সে টাকাও গ্রহণ করতে হয় অপরিচিত মাধ্যম থেকে। এ জন্য মূল হোতারা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে।


বাংলাদেশ জুয়েলারি ব্যবসায়ী সমিতি যশোরের সভাপতি রকিবুল ইসলাম চৌধুরী সঞ্জয় বলেন, ‘সোনা চোরাচালানে জড়িত মূল হোতারা আটক হয় না। বিজিবির কাছে যে পরিমাণ সোনা জব্দ হয়, এর চেয়ে অনেক বেশি পাচার হয়। এতে আমাদের বদনামও হয়, আমরা ক্ষতিগ্রস্তও হই।’


এই বিষয়ে ৪৯ বিজিবি যশোর ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আহমেদ হাসান জামিল আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিজিবি অভিযান চালিয়ে সোনা জব্দ করে ও আসামির বিরুদ্ধে মামলা দেয়। এরপর এসব মামলার তদন্তভার পুলিশের ওপর বর্তায়। নেপথ্যে থাকা চোরাকারবারিকে সামনে আনবে তদন্তকারী ইউনিট। এরপরও বিজিবি সজাগ ও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।’


যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) বেলাল হোসাইন বলেন, ‘সোনা চোরাকারবারিদের রিমান্ড চেয়ে চালান দেওয়া হয়। রিমান্ডে বহনকারীরা মুখ না খোলায় এবং পর্যাপ্ত তথ্য না দেওয়ায় রাঘববোয়ালরা পার পেয়ে যান। এ ছাড়া তথ্য পেলেও পর্যাপ্ত প্রমাণ ও সাক্ষীর অভাবে অনেক সময় আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে যান রাঘববোয়ালরা।’


শেয়ার করুন