আয় ও ব্যয় সমান রেখে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) ১ হাজার ১৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। আজ বুধবার দুপুরে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন এ বাজেট ঘোষণা করেন। গত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বাজেটের এর লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ১ হাজার ৭ কোটি ১৯ লক্ষ ৬৯ হাজার ৩২৩ টাকা ১১ পয়সা। সংশোধিত বাজেটে এর আকার ৬১৮ কোটি ১১ লক্ষ ২ হাজার ২১০ টাকা ১৭ পয়সা দাঁড়িয়েছে।
২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট : আয় ও ব্যয় সমপরিমাণ ধরে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটের লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে ১ হাজার ১৫ কোটি ৩৪ লক্ষ ৭০ হাজার ১০০ টাকা।
বাজেট ঘোষণা অনুষ্ঠানে মেয়র বলেন, পরম করুণাময় আল্লাহর নিকট শুকরিয়া আদায় করছি, যিনি আমাকে তৃতীয়বারের মতো রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে নগরবাসীর সেবা করার সুযোগ প্রদান করেছেন। আমি বিনম্র চিত্তে পরম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের শহীদ সদস্যগণকে। আমি আরো গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি জাতীয় চার নেতা সহ মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের, যাদের রক্তের বিনিময়ে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমি অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি, যিনি আমাকে তার স্নেহছায়ায় রেখেছেন।
পরিচ্ছন্ন, সবুজ, শিক্ষা ও আমের রাজধানীখ্যাত পদ্মা নদীর পাশে গড়ে উঠেছে প্রাচীন জনপদ রাজশাহী নগরী। হযরত শাহ্ মখদুম (রহঃ) ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ এ. এইচ. এম কামারুজ্জামান এবং দেশের প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. শামসুজ্জোহা এই নগরীতে চিরশায়িত আছেন, তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। প্রায় ১০ লক্ষ জনগোষ্ঠীর রাজশাহী মহানগরী দেশীয় ও আর্ন্তজাতিকভাবে সবুজ, পরিচ্ছন্ন, পরিবেশসম্মত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসযোগ্য নগরী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রিয় নগরবাসীর সার্বিক সহযোগিতা ও সিটি কর্পোরেশনের সম্মানিত কাউন্সিলর, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সকলের নিরলস প্রচেষ্টায় এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। নগরীর অনেক কীর্তিমান ব্যক্তি যারা আমাকে চিন্তা-চেতনা পরামর্শ দিয়ে এই আধুনিক শহর বিনির্মাণে সহায়তা করেছেন তাদেরকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
সম্মানিত কাউন্সিলরবৃন্দ ও সাংবাদিকবৃন্দ,
আজ রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের ৭ম পরিষদের ১ম বাজেট। নগরবাসীর আশা-আকাঙ্খা প্রতিফলন ঘটানোর প্রত্যাশা ও রাজশাহী মহানগরীকে স্মার্ট নগরীতে রুপান্তরিত করার লক্ষ্যে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরের সংশোধিত বাজেট ও ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছি। বাজেট হচ্ছে কোন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক পরিকল্পনার চিত্র, যেখানে সুনির্দিষ্ট একটি বছরের সম্ভাব্য বরাদ্দসহ অগ্রাধিকার ভিত্তিক পরিকল্পিত ভবিষ্যৎ কর্মসূচির সার্বিক রূপরেখা প্রতিফলিত হয়।
রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন স্থানীয় সরকার সিটি কর্পোরেশনের আইন ২০০৯ দ্বারা পরিচালিত হয়। এছাড়া সরকার কর্তৃক স্থানীয় সরকার এর বিভিন্ন বিধিমালা রয়েছে, যা অনুসরণ করতে হয়। বাজেটে রাজস্ব আয়ের জন্য বিভিন্ন কর, অন্যান্য সম্পদ আহরণ এবং ব্যবস্থাপনা প্রকল্প প্রনয়ন ও বাস্তবায়ন, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, স্যানিটেশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) সর্ম্পকে মৌলিক ধারণা, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসুচি বাস্তবায়ন, পরিবেশ দুষণ ও পরিবেশ সংরক্ষণে করণীয়, তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার ও উদ্ভাবনী উদ্যোগ, অফিস ব্যবস্থাপনা আধুনিকরণ, ডিজিটাল নথি ব্যবস্থাপনা, শ্রদ্ধাচার কৌশল পত্র এবং বাৎসরিক বাজেট প্রনয়ন করতঃ এগুলো যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়, সে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
এবার আমার নির্বাচনী স্লোগান ছিল ‘উন্নয়ন দৃশ্যমান, এবার হবে কর্মসংস্থান’। আগামী দিনে আমি ব্যাপক কর্মসংস্থান এবং বেকারত্ব হ্রাস ও উদ্যোক্তা সৃষ্টি সহ আমার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিসমূহ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নে সচেষ্ট থাকবো।
প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা, ২০৪১ সাল নাগাদ আমাদের দেশ হবে স্মার্ট ও উন্নত বাংলাদেশ। সেই পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্মার্ট রাজশাহী বিনির্মাণে ৮ই আগস্ট ২০২৩ তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের সাথে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের এক চুক্তি স্বাক্ষর হয়। গত ১৪ই অক্টোবর হতে ১৯ অক্টোবর ২০২৩ তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগিতায় রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে ৬ দিনব্যাপি রাজশাহী মহানগরীর সকল সেবা প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ ও রাজশাহীর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ ও দেশের প্রথিতযশা প্রকৌশলী, জনপ্রতিনিধি নিয়ে আগামীর স্মার্ট রাজশাহীর ধারণাপত্র তৈরী করা হয়েছে। এতে মোট ১৬২টি ইনিশিয়েটিভ রয়েছে, যা আগামী ১৫ বছরের মধ্যে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হবে।
বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা বর্তমান সরকারের অন্যতম সাফল্য। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন, দারিদ্র্য বিমোচন, গৃহহীনদের জন্য আবাসন, কৃষিতে অভূতপূর্ব উন্নয়নসহ বাংলাদেশকে উন্নত ও মর্যাদাশীল দেশ হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের চলমান, স্বল্প মেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ইতোমধ্যে করেছি। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে রাজশাহী একটি উন্নত বাসযোগ্য স্মার্ট সিটিতে রূপান্তর হবে।
প্রিয় সাংবাদিক ও সহকর্মীবৃন্দ,
বিগত পাঁচ বছরে যে সকল উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে, বর্তমানে চলমান রয়েছে এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাস্তবায়িত হবে, তার বিস্তারিত বিবরণ আমি আপনাদের নিকট উপস্থাপন করছি:-
১। রাজশাহী কল্পনা সিনেমা হল থেকে তালাইমারী মোড় পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন (১ম সংশোধিত) প্রকল্প : ১৬৪
কোটি ১৯ লক্ষ ২৯ হাজার টাকা ব্যয় সাপেক্ষে প্রকল্পটির আওতায় মহানগরীর আলুপট্টি মোড় হতে তালাইমারী মোড় পর্যন্ত আড়াই কিলোমিটার সড়কটি প্রশস্ত করে চারলেন সড়কে উন্নীতকরণ করা হয়েছে। সড়কটির উভয় পাশে দৃষ্টিনন্দন ফুটপাথ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন সড়ক বাতি স্থাপন করা হয়েছে। সড়কের আইল্যান্ডে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে সৌন্দর্য্যবৃদ্ধি করা হয়েছে।
২। রাজশাহী মহানগরীর রাজশাহী-নওগাঁ প্রধান সড়ক হতে মোহনপুর-রাজশাহী-নাটোর সড়ক পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিম সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্প : ১৮৯ কোটি ৩৪ লক্ষ ৫৯ হাজার টাকা ব্যয় সাপেক্ষে প্রকল্পটির আওতায় রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের আলিফ লাম মীম ভাটার মোড় হতে ছোটবনগ্রাম, মেহেরচন্ডী, বুধপাড়া, মোহনপুর হয়ে চৌদ্দপায়া রাজশাহী-নাটোর সড়ক পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিম সংযোগ সড়ক নির্মাণ কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পটির আওতায় নগরীর ২টি মহাসড়কের পূর্ব-পশ্চিমমুখি ৬.৭৯৩ কিলোমিটার ৪ লেন সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও সড়কের দুই পাশে ফুটপাত, রেলওয়ে ক্রসিং-এ ১টি ফ্লাইওভার, ১টি ব্রীজ, ৮টি কালভার্ট, মিডিয়ান ও ট্রাফিক কাঠামো ইত্যাদি কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর ফলে মহানগরীর ক্রমবর্ধমান যানজট পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধিত হয়েছে। একই সাথে প্রকল্প এলাকায় আবাসনসহ আর্থ-সামাজিক ও পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
৩। রাজশাহী মহানগরীর উপশহর মোড় হতে সোনাদিঘী মোড় এবং মালোপাড়া মোড় হতে সাগরপাড়া মোড় পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন প্রকল্প : ১২৬ কোটি ৩৯ লক্ষ ৯৯ হাজার টাকা ব্যয় সাপেক্ষে প্রকল্পটির আওতায় মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ উপশহর মোড় হতে দড়িখরবোনা, কাদিরগঞ্জ, মহিলা কলেজ, মালোপাড়া পুলিশ ফাঁড়ি হয়ে সোনাদীঘি মোড় এবং মালোপাড়া মোড় হতে রাণীবাজার মোড় হয়ে সাগরপাড়া বটতলা মোড় পর্যন্ত সড়কটি প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর ফলে নগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমুল পরিবর্তন হয়েছে। এর ফলে রাস্তার দুই ধারে বহুতল ভবন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে তৈরী হয়েছে।
৪। রাজশাহী মহানগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার উন্নয়ন প্রকল্প :
১৯৮ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষে প্রকল্পের আওতায় মহানগরীর ওয়ার্ডসমূহে ক্ষতিগ্রস্থ ও নতুন কার্পেটিং সড়ক নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় নগরীর বিলসিমলা থেকে কাশিয়াডাঙ্গা সড়ক ফোরলেনে উন্নীত করা হয়েছে, সাথে ড্রেন, ফুটপাত ও বাই সাইকেল লেন নির্মিত হয়েছে। সড়কটিতে দৃষ্টিনন্দন প্রজাপতি সড়কবাতি স্থাপন করা হয়েছে। মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর সরণি সড়কটির রক্ষণাবেক্ষণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়াও প্রকল্পের আওতায় ৩৬.৮১ কিলোমিটার নতুন সড়ক, রাস্তা সংস্কার ৫৮.৬৯ কি.মি. ড্রেন ৩৩.৬০ কি.মি এবং ফুটপাত ১২.৪৩ কি.মি কাজ বাস্তবায়িত হয়েছে। সড়কসমূহে দৃষ্টিনন্দন সড়ক বাতি স্থাপন করা হয়েছে।
৫। রাজশাহী মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে ক্ষতিগ্রস্থ সড়ক ও নর্দমা সমূহের উন্নয়ন প্রকল্প:
৪৯ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকা ব্যয় সাপেক্ষে প্রকল্পটির আওতায় মহানগরীর ওয়ার্ডসমূহের প্রান্তিক এলাকায় ক্ষতিগ্রস্থ কার্পেটিং, সিসি ও নর্দমা নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। তাছাড়াও মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ সোনাদীঘি মোড় হতে সদর হাসপাতাল মোড় পর্যন্ত সড়কটির দুই পাশে দৃষ্টিনন্দন ফুটপাত নির্মাণ এবং প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন কাজ সমাপ্ত হয়েছে। কার্পেটিং নতুন সড়ক ৪.৩২ কি.মি. কার্পেটিং রাস্তা সংস্কার ১.৪২কি.মি এবং সিসি রাস্তা ৫৩.২৯ কি.মি.এবং ৩৬.৭২ কি.মি. ড্রেন নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়েছে।