বিএনপি বলেছিল, আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে কঠোর কর্মসূচি দিয়ে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করবে। আদায় করে নেবে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি। দলটির ঘোষিত সময়সীমা অনুযায়ী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্ব এখন চলছে। হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচিও তারা দিচ্ছে। কিন্তু কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া পর্যন্তই, মাঠে নেই তাদের নেতা-কর্মীরা। ফলে এই ধারার আন্দোলন-কর্মসূচি সরকারের ওপর সেই অর্থে কোনো চাপ তৈরি করতে পারবে বলে মনে করছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
এ অবস্থায় গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে এ পর্যন্ত পাঁচ দফায় ১১ দিনের অবরোধ ও দুই দফায় তিন দিনের হরতাল শেষ হলো আজ মঙ্গলবার। আজকের দিনটা বিরতি দিয়ে আগামীকাল বুধবার থেকে আবার ৪৮ ঘণ্টার অবরোধের ডাক দিয়েছে বিএনপি।
বিরোধীদের এই হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি আদৌ কোনো কাজে আসছে কি না জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার মতে, বিএনপি ভুল কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। এটা এখন অনেকটাই পরিষ্কার যে এই আন্দোলন দিয়ে নির্বাচন ঠেকানো বা সরকারের পতন ঘটানো যাবে না।’
চলমান কর্মসূচি প্রসঙ্গে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমানের সঙ্গে কথা হয় এভাবে আর কত দিন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কত দিন চলবে, এটা তো বলা যাচ্ছে না। এটা পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। পরিস্থিতি যখন যেমন আসবে, আমরা সে অনুযায়ী কর্মসূচি দেব। আমরা আন্দোলনে আছি এবং দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনে থাকব। এটাই আমাদের সিদ্ধান্ত।’
২৮ অক্টোবরে ভেস্তে গেছে পরিকল্পনা সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের এক দফা দাবিতে দীর্ঘ দিন থেকে আন্দোলন করে আসছে বিএনপি ও দলটির সমমনা দল ও জোটগুলো। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ আয়োজনের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত দফার কর্মসূচি পালন শুরু করে তারা। ওই দিন প্রাণঘাতী সংঘর্ষে মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে লাগাতার হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি পালন করে আসছে তারা। লাগাতার কর্মসূচি পালনের মধ্যেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে গত রোববার সকাল থেকে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল পালন করছে তারা, যা শেষ হচ্ছে আজ মঙ্গলবার সকালে। এই কর্মসূচি শেষ হওয়ার আগেই গতকাল সোমবার বিকেলে নতুন কর্মসূচি হিসেবে বুধবার থেকে আবারও ৪৮ ঘণ্টার অবরোধের ডাক দিয়েছে বিএনপি।
বিএনপিসহ এক দফার আন্দোলনে যুক্ত দলগুলোর দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে তাঁরা জানান, চূড়ান্ত পর্যায়ে হরতাল-অবরোধের পাশাপাশি ঘেরাও, অবস্থান ও সভা-সমাবেশ করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের পরে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তাতে আর আগের পরিকল্পনায় থাকা সম্ভব হচ্ছে না। গণহারে গ্রেপ্তার, মামলা ও হামলা-সংঘর্ষের ভয়ে নেতা-কর্মীরা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কর্মসূচির দিনে অনেকটা নিয়ম রক্ষার মতো করে অতি অল্প সময়ের জন্য রাস্তায় নামছেন। এ অবস্থায় হরতাল-অবরোধকেই উপযুক্ত কর্মসূচি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দফার আন্দোলনে যুক্ত একটি জোটের শীর্ষ নেতা বলেন, ঘেরাও-অবস্থানের মতো কর্মসূচি পালন করতে হলে ব্যাপকসংখ্যক নেতা-কর্মীর উপস্থিতি দরকার পড়ে। সেটা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। আবার রাজপথ ছেড়ে যাওয়াও সম্ভব নয়। এ অবস্থায় অনেকটা বাধ্য হয়েই হরতাল-অবরোধকে বেছে নিতে হয়েছে। ১৪ হাজার নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার ২৮ অক্টোবর-পরবর্তী পরিস্থিতিতে অব্যাহত গ্রেপ্তার-মামলায় দেশজুড়ে গণহারে গ্রেপ্তার হচ্ছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও শীর্ষ আরও অনেক নেতাসহ এরই মধ্যে বন্দী হয়েছেন অসংখ্য নেতা-কর্মী।
নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারের চিত্র তুলে ধরে গতকাল সোমবার বিকেলে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ঢাকার মহাসমাবেশের চার-পাঁচ দিন আগে থেকে এ পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপির অন্তত ১৪ হাজার নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই সময়ে মামলা হয়েছে ৩৩১টি। কর্মসূচি পালনকে ঘিরে সারা দেশে অন্তত ১৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ৪ হাজারের বেশি নেতা-কর্মী। গত ২৪ ঘণ্টায়ই সারা দেশে বিএনপির অন্তত সাড়ে চার শ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানান রিজভী।
লাগাতার কর্মসূচি ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে কর্মসূচি ডেকেও সেই অর্থে মাঠে থাকছেন না বিএনপির নেতা-কর্মীরা। অথচ লাগাতার কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। লাগাতার হরতাল-অবরোধকে শুরুতে আমলে নিলেও জীবিকার প্রয়োজনে এখন অনেকেই আর পাত্তা দিচ্ছে না। গত কয়েক দিনে ব্যস্ত সড়কগুলোতে এর প্রতিফলন লক্ষ করা গেছে।
ঢিলেঢালা হরতালে গতকাল রাজধানীতে যানবাহন চলাচল অনেকটাই বেড়েছে। কিছু কিছু জায়গায় স্বাভাবিক দিনের মতোই যানজটও দেখা দেয়।
হরতালের দিনে এমন যানজটের কারণ জানতে চাইলে রাজধানীতে চলাচলকারী ভিক্টর ক্লাসিক বাসের কন্ডাক্টরের সহজ উত্তর, ‘মানুষ কি না খাইয়া থাকব?’ তাঁর কথা শেষ না হতেই ওই গাড়ির চালক বলে ওঠেন, ‘এই নাটক আর কত দিন চলবে কে জানে। পেটে ভাত দিতে হইলে তো বাইর হইতেই হবে।’
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বিএনপি ও বিরোধীদের লাগাতার কর্মসূচি পালনকে সুচিন্তিত মনে করছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে, বিরোধীদের আন্দোলন সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে তো পারেইনি, নিজেরাই শক্তি হারিয়েছে। অন্যদিকে হরতাল-অবরোধে জানমালের ক্ষতি ও জনভোগান্তির কারণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিএনপির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে, যা তাদের জন্য আরও বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।