২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০৩:০০:৩৪ পূর্বাহ্ন
৩০ নভেম্বরের পরীক্ষায় পাশ, বিএনপির ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়নের আশ্বাস
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৪-১২-২০২৩
৩০ নভেম্বরের পরীক্ষায় পাশ, বিএনপির ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়নের আশ্বাস

দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির বিভিন্ন স্তরের বেশকিছু নেতা হাইকমান্ডের কাছে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ছিলেন। দলের বাইরে গিয়ে সরকারের সঙ্গে আঁতাত, জোট বেঁধে ব্যবসা ও দলীয় কর্মসূচিতে অনুপস্থিত থাকার অভিযোগ ছিল অনেকের বিরুদ্ধে। আসন্ন নির্বাচনে তাদের অংশগ্রহণ নিয়ে ছিল নানা গুঞ্জন। দলের ক্ষুব্ধ ও বঞ্চিত নেতাদের নিয়েও ছিল কৌতূহল। নানামুখী চাপ। সরকারদলীয় নেতাদের বক্তব্যে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছিল। সবকিছুর অবসান ঘটে ৩০ নভেম্বর বিকাল ৫টায়। মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ মুহূর্তেও অংশ নেয়নি বিএনপির সন্দেহভাজন প্রভাবশালী, ত্যাগী ও পদবঞ্চিতরা। এতে স্বস্তিতে বিএনপি। রাজনৈতিক সংকট ও দলের দুর্দিনে সরকারের ফাঁদে পা না দেওয়ার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসাবে দেখছেন নীতিনির্ধারকরা। আসন্ন নির্বাচন বয়কট করে সন্দেহভাজন নেতারা দলীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। আগামীতে এসব ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়নের আশ্বাসও দিয়েছেন হাইকমান্ড। একই সঙ্গে দলের কোণঠাসা নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে বিএনপি। দলীয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে


বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান যুগান্তরকে বলেন, ‘বিএনপির নেতাকর্মীরা একটি নীতিতে বিশ্বাস করে। যেটা হচ্ছে-ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়। ৩০ নভেম্বর কঠিন পরিস্থিতিতেও তারা (ত্যাগী নেতা) প্রমাণ করেছেন দেশকে ভালোবাসেন। ব্যক্তি স্বার্থে তারা দেশের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেননি। সে কারণে তাদের মূল উদ্দেশ্য গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে। মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে হবে। সেই আদর্শে অবিচল থেকে তারা তাদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছেন। তাদের আদর্শে অবিচল থেকেছেন। সরকার বলছে বিএনপির নাকি কয়েকজন নেতা আওয়ামী লীগে জয়েন করেছে অথবা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। যা মোটেই সত্য নয়। তবে সরকার অনেক চেষ্টা করেছে অর্থের লোভ, নানা রকমের সুযোগ-সুবিধা এবং পদ-পদবির লোভ দেখিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। ৩০০ সিটের আসনে তারা যাদের নিয়েছে, তাদের মধ্যে সত্যিকার বিএনপি কতজন সেটা চিহ্নিত করলেই আওয়ামী লীগের ধাপ্পাবাজি প্রকাশ হয়ে যাবে।’


এদিকে সরকার পতনের একদফা দাবিতে আন্দোলন করছে বিএনপি। আগেই ঘোষণা দিয়েছিল দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করলেও ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন করছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। এমন পরিস্থিতিতে দলটির শীর্ষ, ক্ষুব্ধ ও পদবঞ্চিত নেতাদের নির্বাচনে নিতে নানামুখী চাপের কথা বলেছেন তারা। বিএনপি বলছে-নির্বাচনে প্রলোভন দেখিয়ে নেতাদের ভাগিয়ে নিতে সরকার নানামুখী তৎপরতা চালিয়েছে।


দলকে ভাঙার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েও সফল হয়নি। নির্বাচনকেন্দ্রিক সরকারের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বিএনপি সমমান দল, জোট ও ইসলামিক দলগুলোও ‘একতরফা’ নির্বাচনে সাড়া দেয়নি। নানা প্রলোভন সত্ত্বেও যেসব নেতা নির্বাচনে যাননি, দলকে বিতর্কিত করেনি, তাদের সুবিধামতো সময়ে মূল্যায়ন করবে বিএনপি।


বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা বলেন, ‘এতদিন দলের শীর্ষ নেতাকে ভুল বুঝিয়ে যেসব সিনিয়র নেতাকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে, সাইড লাইনে বসিয়ে রাখা হয়েছে, রাগে-ক্ষোভে, দুঃখে যারা এতদিন নিষ্ক্রিয় ছিলেন, তাদের টার্গেট করেও সরকার ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে দলের মধ্যে ঘাঁপটি মেরে থাকা সিন্ডিকেটের মুখোশও এবার উন্মোচিত হয়েছে। এতদিন তাদের দেওয়া তথ্যকে ভুল প্রমাণিত করে এসব অভিজ্ঞ ও ত্যাগীরা দল ছাড়েননি। বিএনপি হাইকমান্ডের জন্য এটা অনেক বড় পুরস্কার। তারা দলকে ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করতে পেরেছেন। এসব অভিমানী নেতা এখন রাজপথে সক্রিয়।


নীতিনির্ধারণী ফোরামের এক সদস্য বলেন, বিএনপি সুসংগঠিত দল। বিভিন্ন সময়ে দলের প্রয়োজনে অনেকেই পদ-পদবির বাইরে রাখা হয়েছে। অনেকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে বহিষ্কার হয়েছেন। তবুও দলের প্রতি তাদের ভালোবাসা কমেনি। প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে তারা দলকে সুসংগঠিত রাখতে কাজ করেছেন। এ নির্বাচনে তারা তার প্রমাণ দিয়েছেন। দলীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাদের অবশ্যই মূল্যায়ন করা হবে। তাদের সঙ্গে বিএনপি হাইকমান্ড বিভিন্ন মাধ্যমে যোগযোগ রাখছেন। গতিবিধি পর্যবেক্ষণে রাখছেন।


বিএনপির দপ্তর সূত্রে জানা যায়, দলীয় শৃঙ্খলা অমান্য করায় বিগত সময়ে বহিষ্কার হয়েছেন অসংখ্য নেতাকর্মী। দল থেকে বহিষ্কার হলেও তাদের অনেকেই বিএনপির বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। তাদের মধ্যে একজন মেয়রসহ অন্তত ২৫০ জনের অধিক ক্ষমা চেয়ে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে আবেদনগুলো পুনর্বিবেচনা করা হবে বলে জানান বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতা।


বিএনপির অন্তত ৮ জন সাবেক সংসদ-সদস্য ও দলীয় প্রার্থী যুগান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনে নিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছে সরকার। ভয় ও প্রলোভন দেখিয়েছে। নির্বাচনি আসনের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন পর্যন্ত অজানা আতঙ্ক ছিল। বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগও করা হয়েছে। বিষয়টি বিএনপির হাইকমান্ডকে জানানো হয়েছে। তার নির্দেশেই কৌশলে সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে। চাপ মুক্ত থাকতে কেউ কেউ আত্মগোপন করেছেন। এই মুহূর্তে বিএনপির চলমান আন্দোলনে নিজের সক্রিয়তা বাড়াতে দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশনাও পেয়েছেন।


বিএনপি সরকারের সাবেক এক মন্ত্রী বলেন, নির্বাচনি তফশিল ঘোষণার পর সারা দেশে একটা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছিল। নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি বলে নানাভাবে গুজব ছড়িয়েছে। বিএনপি ও জনগণের কাছে বিতর্কিত করতে সব চেষ্টাই চালিয়েছে। তখনও দলীয় হাইকমান্ডের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হতো। তিনি আমাকে সাহস দিয়েছেন, মনোবল শক্ত ও সরকারে ফাঁদে পা না দেওয়ার বিষয়ে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। চাপের কারণে বিএনপির চলমান আন্দোলনে অংশ নিতে পারিনি। নির্বাচন থেকে দূরে থাকতে একটা সময় মোবাইল ফোন বাসায় রেখে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হই।


তিনি বলেন, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর সেখানে একটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘তৃণমূল বিএনপি’ ও ‘বিএনএম’ নামের কিংস পার্টি কোনো চমকই দেখাতে পারেনি। সেখানে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের স্বতন্ত্র নির্বাচনের জন্য দেওয়া হয় প্রচণ্ড চাপ। নির্বাচনের খরচসহ এমপি বানানোরও টোপ দেওয়া হয়। তবে তাতেও খুব বেশি লাভ হয়নি। বিএনপি নেতাকর্মীরা তাতে সাড়া দেননি। বেইমানি না করে দলের ঐক্য অটুট রাখতে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করেছেন দলের নেতাকর্মীরা। তবে আগামীতে দল কিভাবে মূল্যায়ন করবে, সেটি নিয়ে আমরা চিন্তিত নই।


বিএনপির সূত্র বলছে, বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা ও সাবেক এক মন্ত্রী বিভিন্ন সময়ে নানা বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছিলেন। যা নিয়ে দলের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল। পরে অনেকেই বলেছেন, তিনি (সাবেক মন্ত্রী) আওয়ামী লীগ সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছেন। কৌশলে সরকারের সঙ্গে বাণিজ্য করেছেন। বিএনপির দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে যে কোনো সময় সরকারের হাত ধরে নির্বাচনে যাবেন। তবে তিনিও এবার দলীয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। সূত্র আরও বলছে-কারাবন্দি সাবেক ওই মন্ত্রীর সঙ্গে সরকার যোগাযোগ করেও সাফল্য পায়নি।








শেয়ার করুন