রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) প্রধান মো. জহিরুল ইসলাম। রাজধানীর মিরপুরে একটি বাড়ির মালিক তিনি। এ ছাড়া ঢাকার শহীদবাগ ও উত্তরায় কিনেছেন দুটি ফ্ল্যাট। চড়েন ৩৫ লাখ টাকায় কেনা একটি ব্যক্তিগত গাড়িতে। তাঁর স্ত্রীরও কম কিসে? কুমিল্লার ঝাউতলা মৌজায় দুটি ফ্ল্যাট ও ঢাকার কাকরাইলে একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের মালিক তিনি। সব মিলিয়ে এই দম্পতির নামে প্রায় সোয়া ৪ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ নিয়ে ইতিমধ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছে সংস্থাটি।
আরএনবি প্রধান মো. জহিরুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী কাজী জিন্নাতুন নাহারের বিপুল সম্পদের বিষয়ে তদন্ত করছেন দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-১-এর উপপরিচালক মো. নাজমুচ্ছায়াদাত। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, ‘জহিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনসংক্রান্ত অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। সম্পদের বিষয়ে তাঁর কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। তিনি এখনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। ব্যাখ্যার জন্য তিনি আমাদের থেকে সময় নিয়েছেন। আমরা তাঁকে সময় দিয়েছি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জহিরুল ইসলাম ১৯৯০ সালে সাঁটমুদ্রাক্ষরিক কাম টাইপিস্ট পদে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনে (পিএসসি) যোগদান করেন। ২০০০ সালে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণি পদে পদোন্নতি পান। ২০০২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বিসিএস নন-ক্যাডারে (২১তম ব্যাচ) সহকারী কমান্ড্যান্ট পদে, ২০০৬ সালে কমান্ড্যান্ট এবং ২০২০ সালে চিফ কমান্ড্যান্ট পদে বাংলাদেশ রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনীতে পদোন্নতিপ্রাপ্ত হন।
জহিরুল ইসলামের স্ত্রী কাজী জিন্নাতুন নাহার বর্তমানে একজন গৃহিণী। তবে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বাতাবাড়ীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ছিলেন তিনি। ২০১৩ সালে স্বেচ্ছায় অবসরে চলে যান।দুদক জানায়, ২০১৭ সালে রেলওয়ে নিরাপত্তা
বাহিনীতে ১৮৫ জন সিপাহি নিয়োগে অনিয়ম হওয়ার পর অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অনুসন্ধান শেষে নিয়োগে অনিয়ম হওয়ায় ২০২২ সালের ২৮ আগস্ট চিফ কমান্ড্যান্ট জহিরুল ইসলামসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করে সংস্থাটি। এর মধ্যে জহিরুল ইসলামের সম্পদের অনুসন্ধানও শুরু হয়। প্রাথমিক অনুসন্ধানে স্বামী-স্ত্রী দুজনের নামে অস্বাভাবিক সম্পদের তথ্য পায় দুদক। জহিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি-বাণিজ্যসহ নানান অনিয়মের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধানে জহিরুলের সম্পদের যে তথ্য মিলল
২০১৪ সালের ২৯ মে ঢাকার মিরপুরের সেনপাড়া মৌজায় জহিরুল ইসলামসহ ৩৫ জন একটি বাড়ি ক্রয় করেন। ওই বাড়ির দলিলমূল্য ৪ কোটি ৮৮ লাখ ৮৮৮ টাকা। এর মধ্যে ২ কোটি টাকাই দেন জহিরুল ইসলাম। এ ছাড়া ঢাকার শহীদবাগে এ এন জেড প্রোপার্টিজ লিমিটেডের নয়তলাবিশিষ্ট ‘সিপ্রিং ডেল’ নামে একটি ভবনের দ্বিতীয় তলায় ১ হাজার ৫০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কেনেন জহিরুল ইসলাম। ফ্ল্যাটটি তিনি প্রায় ৮০ লাখ টাকা দামে কিনলেও বর্তমানে এটির বাজারমূল্য প্রায় ২ কোটি টাকা।
ঢাকার উত্তরার ১৮ নম্বর সেক্টরের ‘এ’ ব্লকে রাজউক উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পেও ১ হাজার ৬৫৪ বর্গফুট আয়তনের একটি ফ্ল্যাট আছে জহিরুল ইসলামের নামে। এটির দাম প্রায় ৬৫ লাখ টাকা।
রেলওয়েতে চিফ কমান্ড্যান্ট পদে পদোন্নতি পাওয়ার পরপরই প্রায় ৩৫ লাখ টাকা মূল্যে একটি গাড়িও (ঢাকা-মেট্রো-গ-৪২-০৮৭১) ক্রয় করেন জহিরুল।
তাঁর স্ত্রীর নামে যে সম্পদ আছে
জহিরুলের পাশাপাশি তাঁর স্ত্রী কাজী জিন্নাতুন নাহারের সম্পদের খোঁজও নিয়েছে দুদক। এতে উঠে আসে, ২০১২ সালে কুমিল্লার আদর্শ সদর থানাধীন কান্দিরপাড় প্রকাশ্য ঝাউতলা মৌজায় ‘রহমান লজ’ নামে পাঁচতলা ভবনের পঞ্চম তলায় প্রায় ২০ লাখ টাকার ফ্ল্যাট এবং ২০১৮ সালে একই মৌজায় জয়েন্ট লাইফ রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড ডেভেলপারস লিমিটেডের ‘জয়েন্ট লাইফ এস এস গার্ডেন’ নামের ১০তলা ভবনের চতুর্থ তলায় প্রায় ২০ লাখ টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট কিনেছেন কাজী জিন্নাতুন নাহার।
এ ছাড়াও ঢাকার রমনা থানার কাকরাইলের সার্কিট হাউস রোডের ‘কনকর্ড গ্র্যান্ড রুবি’ নামীয় ১৪ তলা আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের চতুর্থ তলায় ১ হাজার ৭৫০ বর্গফুট আয়তনের একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট আছে তাঁর। এই ফ্ল্যাটটি প্রায় ২ কোটি টাকা মূল্যে ক্রয় করেন তিনি, যেখানে বর্তমানে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন।
দুদকের অনুসন্ধানে উঠে আসা সম্পদের বিষয়ে কথা বলতে গত ১৪, ১৫ ও ১৬ নভেম্বর রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ কমান্ড্যান্ট মো. জহিরুল ইসলামের কার্যালয়ে গিয়েও তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা সম্ভব হয়নি। পরে তিনি ১৫ দিনের ছুটিতে যান। তাঁর ছুটি শেষ হয় ১৪ ডিসেম্বর। ছুটি শেষ হওয়ার পর ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বরও কার্যালয়ে যাওয়া হয়। তাঁর অফিস সহকারী জানান, তিনি ঢাকায় আছেন। এরপর তাঁর মুঠোফোনে কয়েক দফা কল দিয়েও সাড়া মেলেনি।
জহিরুল ইসলামের বিপুল সম্পদ ও তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগের কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে—তা জানতে চাইলে রেলপথসচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আরএনবির বিষয়ে দেখভাল করে মহাপরিচালক দপ্তর। তাই এই বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই।’
পরে রেলের মহাপরিচালক মো. কামরুল আহসানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।