২২ নভেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ০১:০৫:৪৩ পূর্বাহ্ন
রাজশাহীর কোটিপতি প্রার্থীও দানের টাকায় ভোট করছেন
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৩-১২-২০২৩
রাজশাহীর কোটিপতি প্রার্থীও দানের টাকায় ভোট করছেন

রাজশাহীর ৬টি আসনের আলোচিত প্রার্থীরা নির্বাচনি ব্যয় নির্বাহের ‘চমকপ্রদ’ তথ্য দিয়েছেন হলফনামায়। তারা নির্বাচনি ব্যয়ের যে পরিমাণ উল্লেখ করেছেন তাও বাস্তবতার নিরিখে অসম্ভব বলে অনেকে মনে করেন।


কেউ কেউ নিজের ব্যবসা-বাণিজ্যের টাকা আবার কেউবা দানের টাকায় নির্বাচন করছেন- এমন তথ্যও দিয়েছেন হলফনামায়। আবার কেউবা আত্মীয়-পরিজনের কাছ থেকে ধার-কর্জ করে নির্বাচনি ব্যয় মেটাবেন বলেও হলফনামায় উল্লেখ করেছেন।


তবে প্রার্থীদের এসব ‘কাল্পনিক’ ব্যয় খাত নিয়ে কারো কিছু করার নেই বলে মনে করছেন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা আরও বলছেন, নির্বাচনে বাস্তবে কে কত টাকা খরচ করলেন এবং নির্বাচন শেষে দাখিলকৃত রিটার্নে কত পরিমাণ উল্লেখ করলেন তা সঠিকভাবে যাচাই করা হয় না। এ সুযোগে প্রার্থীরা নির্বাচনি খরচের কাল্পনিক সব তথ্য হলফনামায় দিয়ে থাকেন।


হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, রাজশাহী-১ (গোদাগাড়ী-তানোর) আসনে আওয়ামী লীগের (নৌকা) প্রার্থী ওমর ফারুক চৌধুরী নিজের ব্যবসার আয় থেকে সম্ভাব্য নির্বাচনি ব্যয় হিসাবে ২০ লাখ টাকা খরচ করবেন। এ খরচ মেটাতে তিনি কারো কাছ থেকে দান বা কর্জ গ্রহণ করেননি। হলফনামায় তিনি ৬০ বিঘা কৃষি জমি থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। রাজশাহী নগরীতে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া একটি বাড়ি আছে। ফারুক চৌধুরীর বছরে আয় ৫০ লাখ টাকা। বছরে খরচ করেন ২৩ লাখ ৬৩ হাজার টাকা।


রাজশাহী-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী চলচ্চিত্র অভিনেত্রী শারমিন আক্তার নিপা ওরফে মাহিয়া মাহি নির্বাচন করছেন মূলত স্বামীর টাকায়। মাহি হলফনামায় বলেছেন, নিজের এবং স্বামীর টাকায় নির্বাচনের খরচ চালাবেন। সম্ভাব্য খরচের পরিমাণ ২৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে স্বামী রকিব সরকার তাকে নগদ ২০ লাখ টাকা দিয়েছেন।


রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনে আওয়ামী লীগের আলোচিত প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ নির্বাচনে ২০ লাখ টাকা খরচ করবেন বলে হলফনামায় উল্লেখ করেছেন। এই টাকা তিনি ব্যবসা থেকে নিয়েছেন। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে দান হিসাবেও তিনি নির্বাচনি খরচের জন্য কিছু টাকা পেয়েছেন।


এর মধ্যে ভগ্নিপতির কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা, ভাতিজার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা, ভায়রা ভাইয়ের কাছ থেকে ৫০ হাজার ও ভাই বয়েন উদ্দিনের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা দান পেয়েছেন। আরও অনেকেই স্বেচ্ছায় তার নির্বাচনি তহবিলে টাকা দেবেন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।


বাগমারা ও রাজশাহী শহরে তার সাত দশমিক ৬৮ একর জমি আছে। যার মূল্য দেখিয়েছেন দুই কোটি ৬২ লাখ টাকা। বাগমারার জামগ্রামে একটি আবাসিক ভবন ও তাহেরপুরে একটি বাণিজ্যিক ভবনের আনুমানিক মূল্য দেখিয়েছেন মাত্র ৬৭ লাখ টাকা। আবুল কালাম আজাদের বাৎসরিক আয় প্রায় দুই কোটি টাকা। বছরে ব্যয় মাত্র ৩৫ লাখ টাকা।


রাজশাহী-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী সংসদ-সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক গত তিন মেয়াদে এমপি ছিলেন। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে এবার স্বতন্ত্র হয়েছেন। হলফনামায় দেয়া তথ্য অনুযায়ী, তিনি নির্বাচনি খরচের উৎস দেখিয়েছেন বেতন ও বাড়ি ভাড়ার টাকা। তার নির্বাচনি সম্ভাব্য দেখানো হয়েছে ৩০ লাখ টাকা। স্থাবর সম্পদের বিবরণীতে উল্লেখ করেছেন- ঢাকার আদাবরের বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটির ১০নং রোডে ৫ কাঠার প্লট। যার মূল্য এক লাখ ২৫ হাজার টাকা। ঢাকার পূর্বাচলে ৭ কাঠা প্লটের দাম দেখিয়েছেন ২৪ লাখ ৪ হাজার টাকা।


গৃহসম্পত্তির বিবরণীতে এনামুল উল্লেখ করেছেন, ঢাকার আদাবরের বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটির ৩নং রোডে ছয় তলা ভবন ও আড়াই কাঠা জমি রয়েছে। যার মূল্য ৩৫ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। বছরে তার আয় ৭০ লাখ টাকা আর ব্যয় ৪০ লাখ টাকা।


রাজশাহী-২ (সদর) আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ফজলে হোসেন বাদশা সম্ভাব্য নির্বাচনি ব্যয়ের উৎস হিসাবে ব্যবসা ও আইন পেশা থেকে আয় দেখিয়েছেন। এ খাতে বাদশা সম্ভাব্য অর্থের পরিমাণ দেখিয়েছেন ১০ লাখ টাকা। তবে ছোট ভাই ফরহাদ হোসেনের কাছ থেকে তিনি দান হিসাবে পেয়েছেন ৫ লাখ টাকা। আর ওয়ার্কার্স পার্টির তহবিল থেকে পেয়েছেন ১০ লাখ টাকা। স্থাবর সম্পত্তি হিসাবে ঢাকার উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পে ৫ কাঠার প্লটের দাম দেখিয়েছেন ৩৭ লাখ ২৭ হাজার টাকা।


রাজশাহী মহানগরীর হড়গ্রামে খোন্দকার মার্কেট অ্যান্ড কমপ্লেক্সের অংশীদার তিনি। বাদশার বাৎসরিক আয় ৪৭ লাখ ৬৭ হাজার টাকা এবং  ব্যয় ১৬ লাখ ৭৭ হাজার টাকা।


রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনে হেভিওয়েট প্রার্থী পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম চতুর্থবারের মতো নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়ছেন। শাহরিয়ার তার নির্বাচনি ব্যয় মেটাবেন নিজের টাকা দিয়েই। এজন্য তিনি সম্ভাব্য ব্যয় ২৫ লাখ টাকা উল্লেখ করেছেন। বছরে শাহরিয়ারের আয় প্রায় আট কোটি টাকা। আর ব্যয় প্রায় তিন কোটি টাকা। আড়ানী, চারঘাট, বাঘা ও গাজীপুরে তার ১৫ দশমিক ৩৪৯ একর জমি রয়েছে। এই জমির দাম দেখিয়েছেন দুই কোটি ৭১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। আর গুলশানে দুটি অ্যাপার্টমেন্ট ও রাজশাহীর আড়ানীতে একটি চারতলা বাড়ির মূল্য দেখিয়েছেন তিন কোটি ২৬ লাখ টাকা। তবে কোনো ব্যাংক ঋণ নেই শাহরিয়ারের।


রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনে এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক এমপি আব্দুল ওয়াদুদ দারা হলফনামায় উল্লেখ করেছেন নিজের আয় থেকে সাড়ে ১২ লাখ টাকা নির্বাচনি ব্যয় মেটাবেন। তার আয়ের প্রধান উৎস কোম্পানির পরিচালক হিসাবে পাওয়া বেতন। তবে নির্বাচনি ব্যয়ের জন্য স্ত্রী মনোয়ারা বেগমের কাছ থেকে তিনি ১০ লাখ টাকা দান পেয়েছেন। তার স্ত্রীর আয়ের উৎস ব্যবসা। নিজের নামে নাটোর, পুঠিয়া ও রাজশাহীতে ৩০৩ শতাংশ জমি রয়েছে। যার মূল্য দেখিয়েছেন ৩৬ লাখ ২১ হাজার টাকা।


এছাড়া ঢাকার বনানীতে স্ত্রীর সঙ্গে একটি যৌথ অ্যাপার্টমেন্টের মালিক দারা। যার মূল্য ১২ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। বছরে দারার আয় ২৬ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। আর ব্যয় ৪৬ লাখ ৩৩ হাজার টাকা।


উল্লেখ্য, কমিশনের বেঁধে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ী একজন সংসদ-সদস্য প্রার্থী ব্যক্তিগত খরচ বাদে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা নির্বাচনি ব্যয় করতে পারবেন।


প্রার্থীদের সম্ভাব্য এসব নির্বাচনি ব্যয় সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহী জেলা রিটার্নিং অফিসার ও রাজশাহী জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, সম্ভাব্য নির্বাচনি ব্যয় একটি কাল্পনিক বিষয়। কেউ হয়তো বেশি খরচ করছেন কেউবা কম। নির্বাচন শেষে খরচের রিটার্ন দাখিলের সময় এসব খরচের বিষয়ে তেমন খোঁজখবর নেওয়া হয় না। তবে অস্বাভাবিক ব্যয় হলে তার উৎস সম্পর্কে প্রার্থীর কাছ থেকে জানতে চাওয়া হয়।


শেয়ার করুন