২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০৩:০৮:১৮ অপরাহ্ন
শিল্পে এলপিজি ব্যবহারের নীতিমালা হচ্ছে
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৮-১২-২০২৩
শিল্পে এলপিজি ব্যবহারের নীতিমালা হচ্ছে

দেশে চাহিদার তুলনায় প্রাকৃতিক গ্যাসের ঘাটতির কারণে দীর্ঘদিন ধরে শিল্প-কারখানায় গ্যাসসংকট চলছে। একই সঙ্গে আবাসিক ও পরিবহন খাতেও গ্যাসের সংকট আছে। এ অবস্থায় শিল্প উৎপাদন অব্যাহত রাখতে গ্যাসের বিকল্প হিসেবে অনেক শিল্পোদ্যোক্তা উচ্চমূল্যে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করছেন। কিন্তু ডিজেলের তুলনায় তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ব্যয় অর্ধেকেরও কম।


 


এ অবস্থায় বিকল্প জ্বালানি হিসেবে শিল্পে এলপিজি ব্যবহারের জন্য খসড়া নীতিমালা তৈরি করছে সরকার। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এরই মধ্যে ছোট-বড় অনেক ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এলপিজি সরবরাহের অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে।


শিল্প খাতে এলপিজি ব্যবহারের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে গত নভেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর (বীরবিক্রম) সভাপতিত্বে বৈঠক হয়েছে।


সভায় এলপিজি ব্যবহারের জন্য খসড়া নীতিমালা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়।


 


সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সভায় শিল্প খাতে এলপিজি ব্যবহারের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা; এলপিজি ব্যবহারের কারিগরি ও বাণিজ্যিক দিকের সঙ্গে অন্যান্য জ্বালানির তুলনা; এলপিজি ব্যবহারে উৎসাহ প্রদানের জন্য প্রণোদনা নির্ধারণ এবং শিল্প খাতে এলপিজি ব্যবহারের জন্য খসড়া নীতিমালা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়। সভায় বিষয়গুলো পর্যালোচনা ও চিহ্নিত করার লক্ষ্যে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিবকে কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। কমিটিকে আগামী দুই মাসের মধ্যে নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।


 


এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মো. নুরুল আলম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শিল্প-কারখানায় এলপিজির ব্যবহারের জন্য আমরা নীতিমালার কাজ শুরু করেছি। আশা করছি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই খসড়া নীতিমালার কাজ শেষ করতে পারব।’


এলপিজি খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বর্তমানে দেশে এলপিজির চাহিদা ১৮ লাখ টন। মোট চাহিদার ১০ থেকে ১৩ শতাংশ শিল্পে ব্যবহার হচ্ছে। সরকারের নীতি সহায়তা পেলে আগামী এক বছরে কয়েক গুণ বাড়বে শিল্পে এলপিজির ব্যবহার।


এতে চাপ কমবে গ্রিডের প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর।


 


শিল্প-কারখানাগুলো সাধারণত নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় গ্যাস, ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। ক্যাপটিভ হিসেবে পরিচিত এই বিদ্যুৎ দিয়ে গার্মেন্টশিল্পে বৃহৎ পরিসরে বয়লার ও ডায়িং মেশিন চালানো হয়। এর বাইরে ইস্পাত, ধাতব শিল্প, সিরামিকসহ বিভিন্ন ভারী শিল্প-কারখানায়ও গ্যাসের ব্যাপক ব্যবহার হয়।


এলপিজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, শিল্প-কারখানায় বয়লার চালাতে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে লাভজনক হলো প্রাকৃতিক গ্যাস। কিন্তু এর সরবরাহ কমে যাওয়ায় কারখানা মালিকরা বাধ্য হয়ে এলপিজির দিকে ঝুঁকছেন। শিল্পের পরিচালন ও উৎপাদন ব্যয় কমাতে এলপিজি সহায়ক। কারণ এর দাম ডিজেলের অর্ধেক। এখন সরকারি কৌশলগত নীতি সহায়তা দিলে শিল্পে এলপিজির ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো যাবে। এতে শিল্পে উৎপাদন অব্যাহত থাকবে এবং রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে না।


দেশের বাজারে এলপিজি সরবরাহকারী শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বসুন্ধরা, ওমেরা, বেক্সিমকো, ওরিয়ন, নাভানা, বিএম উল্লেখযোগ্য। তবে ২০ থেকে ২২টি কম্পানি বাজারে সক্রিয় আছে। প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে এই খাতে। সৌদি আরামকোর মূল্যতালিকার ভিত্তিতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) প্রতি মাসে দেশে এলপিজির দাম নির্ধারণ করে দেয়। বর্তমানে চাহিদার উল্লেখযোগ্য এলপিজিই আবাসিকে ব্যবহার হচ্ছে।


জানতে চাইলে ওরিয়ন গ্যাস লিমিটেডের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) প্রকৌশলী অনুপ কুমার সেন কালের কণ্ঠকে বলেন, এলপিজির ব্যবহার বাড়িয়ে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার কমানোর জন্য সরকার বেসরকারি এলপিজি খাতকে উৎসাহিত করছে। কিন্তু এলপিজির ব্যবহার সেভাবে বাড়ছে না। তিনি বলেন, এর মধ্যে সরকারের অনুমতি নিয়ে বেশ কয়েকটি এলপিজি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বাজারে এসেছে। ফলে অপারেটরদের যে হারে এলপিজি বিক্রি হওয়ার কথা ছিল, সেই হারে বিক্রি হচ্ছে না। এতে অনেক প্রতিষ্ঠান আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এখন সরকার যদি বিকল্প জ্বালানি হিসেবে শিল্পে এলপিজি ব্যবহারে উৎসাহিত করে, তাহলে এর ব্যবহারের জন্য যেসব যন্ত্রাংশ আমদানি করতে হয় সেগুলোতে যেন শুল্ক সুবিধা দেওয়া হয়। এতে অবকাঠামো নির্মাণ ব্যয় কমে যাবে এবং শিল্পোদ্যোক্তারা এলপিজি ব্যবহারে উৎসাহিত হবেন।


অনুপ কুমার সেন বলেন, এলপিজির উৎপাদন পর্যায়ে যে ৫ শতাংশ ভ্যাট আছে, তা শিল্পে এলপিজি সরবরাহ করার ক্ষেত্রে তুলে দিতে হবে। তাহলে শিল্পোদ্যোক্তারা অনেকটা আমদানীকৃত দামেই এলপিজি কিনতে পারবেন। এতে শিল্পোদ্যোক্তারা সহনশীল দামে এলপিজি পাবেন।


বসুন্ধরা এলপি গ্যাস লিমিটেডের জাকারিয়া জালাল কালের কণ্ঠকে বলেন, শিল্পে গ্রিডের গ্যাসের সংকট থাকায় এলপিজির ব্যবহার বাড়ানোর বিকল্প নেই। ডিজেলের চেয়ে অনেক কম ব্যয় হওয়ার কারণে শিল্পে এলপিজির ব্যবহার বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। শিল্পে এলপিজির ব্যবহারের জন্য যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক সুবিধাসহ বিক্রির ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স অব্যাহতি দেওয়া হলে এর ব্যবহার এক বছরেই কয়েক গুণ বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।


বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) গতকাল মঙ্গলবার দেশের জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ করেছে দুই হাজার ৫৭২ মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদা ছিল চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে পার্থক্য ছিল এক হাজার ৪২৮ মিলিয়ন ঘনফুট।


শিল্পে এলপিজির ব্যবহার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত গত নভেম্বরের বৈঠকে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং তাদের অঙ্গসংগঠনের প্রধান নির্বাহীসহ বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় ‘এলপিজি : বাংলাদেশের শিল্পের জন্য বিকল্প জ্বালানি সমাধান’ শীর্ষক প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন এলপিজি ব্যবসায়ীদের সংগঠন এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (লোয়াব) সভাপতি আজম জে চৌধুরী।


সভায় লোয়াব সভাপতি বলেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এলপিজিকে বিকল্প শিল্প জ্বালানিতে পরিণত করতে সরকার একটি নীতি প্রণয়ন করতে পারে। এতে এলপিজি কম্পানিগুলো আগামী পাঁচ বছরের মধ্যেই প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারবে।


জানতে চাইলে দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, এখন সরকার চাইলেই গ্রিডে গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে পারছে না। আবার ডিজেলের চেয়ে এলপিজির খরচ কম। তাই কারখানার মালিকরা ডিজেলের বিকল্প হিসেবে এলপিজি ব্যবহার করতে পারেন। তবে সঙ্গে দেশীয় গ্যাসের অনুসন্ধান ও উত্তোলনে ব্যাপকভাবে জোর দিতে হবে। কারণ তা সবচেয়ে সস্তা।


শেয়ার করুন