বিগত দুটি নির্বাচনসহ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সংঘটিত অগ্নিসংযোগ ও নাশকতার ঘটনা ‘রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়’ ঘটছে উল্লেখ করে জাতিসংঘকে চিঠি দিয়েছে বিএনপি। একই সঙ্গে ৩০টি ঘটনার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে রোববার ঢাকার বিভিন্ন দূতাবাসে চিঠি দিয়েছে দলটি। বিগত দুটি সংসদ নির্বাচনের ১০টি, ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ১০টি ও ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে ঘটে যাওয়া ১০টি ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে চিঠিতে।
এতে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচনকে ঘিরে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নাশকতা চলছে। বাস-ট্রেনে অগ্নিসংযোগ সরকারের পূর্বপরিকল্পিত। বিএনপির ওপর দায় চাপানো উদ্দেশ্যমূলক। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা বিনষ্ট করছে আওয়ামী লীগ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাংশ। বিএনপির ওপর দায় চাপিয়ে সরকার সুবিধা নিচ্ছে।’ রোববার বিকালে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে চিঠিটি পাঠ করে শোনান বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
এদিকে রোববার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এনডিআই ও আইআরআই নির্বাচন পর্যবেক্ষক টিমের সঙ্গে বৈঠক করে দেশের চলমান পরিস্থিতি তুলে ধরে বিএনপি। তার আগে শনিবার কমনওয়েলথ এবং কয়েকদিন আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নির্বাচন বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে বৈঠক করে দলটি।
চিঠিতে বলা হয়, চলমান অগ্নিসংযোগের প্রতিটি ঘটনায় একমাত্র বেনিফিশিয়ারি আওয়ামী লীগ ও তার অধীন রাষ্ট্রযন্ত্র। অন্যদিকে এসব ঘটনায় প্রধান ভুক্তভোগী বিএনপি। ক্ষমতাসীন শীর্ষ নেতৃত্ব ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কোনো তদন্ত, তথ্য বা সূত্র ছাড়াই প্রতিটি ঘটনার পরপর অবলীলায় ও একই সুরে অগ্নিসন্ত্রাসের দায় বিএনপির ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। নিজেদের সুপরিকল্পিত এই ধ্বংসযজ্ঞকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে অপব্যবহার করে তারা রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নকে উসকে দিচ্ছেন। যা শেখ হাসিনার প্রতিহিংসামূলক বক্তব্যে বারবার প্রমাণিত হয়েছে।
১৯ ডিসেম্বর ট্রেনে মর্মান্তিক ঘটনার উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়েছে, ঢাকায় চলন্ত ট্রেনের তিনটি বগিতে অগ্নিসংযোগ করা হয় এবং চারজন যাত্রী মারা যান। ঘটনার বিশ্লেষণে প্রতীয়মান যে, রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি চিহ্নিত অংশের যোগসাজশে এ নাশকতা সংঘটিত হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের ২ দিন আগে ১৯ ডিসেম্বরের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে বিশেষভাবে সরকারি হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত শয্যা, জরুরি পরিষেবা, ডাক্তার এবং অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখার জন্য ডিএমপির পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। আমাদের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, এই নির্দেশনাটি কোনো কাকতালীয় বিষয় নয়। ডিএমপির এই প্রস্তুতিমূলক উদ্যোগ কেন নেওয়া হয়েছিল, নাশকতার সুস্পষ্ট তথ্য ও পরিকল্পনা তাদের কাছে কীভাবে এলো এবং তারপরও এটি রোধে কেন তারা কোনো ব্যবস্থা নিল না, জনমনে এসব প্রশ্ন রয়েছে।
চিঠিতে আরও বলা হয়, বিগত বছরগুলোতে বিএনপি যতবার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, আওয়ামী লীগও একই দিনে পরিকল্পিত নাশকতার উদ্দেশ্যে কর্মসূচি আহ্বান করেছে। আমরা দলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সর্বদা একটি অহিংস আন্দোলন বজায় রাখার ওপর জোর দিয়েছি এবং সব উসকানি এড়ানোর আহ্বান জানিয়েছি। ২৮ অক্টোবর আমরা (বিএনপি) ঢাকায় একটি মহাসমাবেশের আয়োজন করেছিলাম, যেখানে সারা দেশ থেকে গণতন্ত্রকামী লাখ লাখ মানুষ যোগ দিয়েছিলেন। নানা প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আবারও প্রমাণ করেছিল, বিএনপির পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে এবং একটি সত্যিকারের নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের বিব্রতকর পরাজয় অনিবার্য। এজন্য মহাসমাবেশকে বানচাল ও চলমান শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে, সেদিন একটি ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে শেখ হাসিনার আজ্ঞাবহ পুলিশের চিহ্নিত অংশ।
ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, মুখোশধারী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা পুলিশের সহায়তায় প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা চালায় এবং পুলিশ হাসপাতালের সামনে বাস ও গাড়িতে আগুন দেয়। তারা প্রকাশ্য দিবালোকে একজন পুলিশ সদস্যকে হত্যাও করে, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে পুলিশের কেউ তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেনি, যা ভিডিওতে স্পষ্ট দেখা যায়। এ নৃশংসতার পর, বিএনপির নেতৃত্বে গণতন্ত্রের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলো, ফ্যাসিবাদী অপশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে জোরদারের প্রস্তুতি নিলে আওয়ামী লীগ ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দেশজুড়ে যানবাহনে অগ্নিসংযোগের এক নোংরা কৌশল অবলম্বন করে। অগ্নিসংযোগের ঘটনা বন্ধ করতে বা প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেফতারে ইচ্ছাকৃত নিষ্ক্রিয়তা প্রমাণ করে যে, পুলিশের সহযোগিতায় ও পরিকল্পিতভাবে এ হামলাগুলো চালানো হচ্ছে। অগ্নিসন্ত্রাসের সময় নীরব দর্শক হিসাবে পুলিশের মৌন সহযোগিতা, নাশকতা শেষে অপরাধীদের অবলীলায় ঘটনাস্থল থেকে সটকে পড়া এবং পরে এর দায়ে বিএনপির লাখ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, প্রায় ২৫ হাজার গণগ্রেফতার ও ২৭ জন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা- গত দুই মাসের ঘটনাপ্রবাহের বিশ্লেষণে আওয়ামী লীগের একটি বৃহৎ ষড়যন্ত্রের আলামত স্পষ্ট। এটি অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিজেরা তালিকা করে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় বিএনপির নেতাকর্মীদের আটক করছে। অগ্নিসন্ত্রাসের অভিযোগে তারা ছাত্রদল ও যুবদলের সদস্যদের টার্গেট করছে, মিথ্যা মামলায় ফাঁসাচ্ছে। পুলিশের দাবি করা তথাকথিত সহিংসতার স্পট থেকে অনেক দূরে, ভিন্ন কোনো এক জায়গা থেকে গ্রেফতারের পর প্রতারণামূলকভাবে সেই গায়েবি ঘটনার সঙ্গে আমাদের ছেলেদের সম্পৃক্ত করে অভিযোগ বানাচ্ছে।
জাতিসংঘ ও ঢাকার বিভিন্ন মিশনে দেওয়া বিএনপির চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, বানোয়াট অভিযোগ ও গায়েবি মামলাগুলো সাজানো হচ্ছে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার পুনরুদ্ধারে বিএনপির আন্দোলনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগের যৌথ এ উদ্যোগ আসলে সরকারের মাস্টার প্ল্যানেরই অংশ। এটি আজ দৃশ্যমান যে, সরকার একটি সিস্টেম্যাটিক ফর্মুলা অনুসরণ করছে। প্রথমে তারা মিডিয়া কাভারেজ দিয়ে নাশকতার ঘটনা তৈরি করে। এরপর বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তিগুলোর ওপর দায় চাপিয়ে আমাদের নেতাকর্মীদের গণগ্রেফতার করে। পরে তারা রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রায় প্রদান করে ও আমাদের চলমান আন্দোলনকে বিতর্কিত করার একটি হীন প্রচার চালায়। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতিনিধিত্বকারী দল বিএনপির সিনিয়র নেতারা সম্মিলিতভাবে অগ্নিসংযোগ করছেন, অবিশ্বাস্য এই হীন অপবাদ চাপিয়েই পুলিশ কাল্পনিক মামলা এবং বানোয়াট অভিযোগ নথিভুক্ত করে চলেছে। এমনকি ইতোমধ্যে বিএনপির যেসব সদস্য মারা গেছেন বা গুমের শিকার হয়েছেন, সেসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ দায়ের করা হচ্ছে। কোনো নিরপেক্ষ বা স্বাধীন সাক্ষী ছাড়াই মিথ্যা পুলিশি সাক্ষ্যকে একমাত্র প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।