২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১১:২২:১৫ অপরাহ্ন
‘সতর্ক ও সঙ্কুলানমুখী’ মুদ্রানীতি ঘোষণা: কমবে মূল্যস্ফীতি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২০-০১-২০২৪
‘সতর্ক ও সঙ্কুলানমুখী’ মুদ্রানীতি ঘোষণা: কমবে মূল্যস্ফীতি

উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে বাজারে অর্থের জোগান আরও কমাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে নীতি সুদহার আরও এক দফা বাড়িয়ে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য ‘সতর্ক ও সঙ্কুলানমুখী’ মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। এ পরিবর্তনের ফলে একদিন মেয়াদি রেপোর (পুনঃক্রয় চুক্তি) সুদ হার সাত দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে আট শতাংশ হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ব্যাংকগুলো যে টাকা ধার করবে, তার সুদহার বাড়বে।


গতবারের মুদ্রানীতিতে নেওয়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলেও আগের চেয়ে বৃদ্ধি পায়নি মন্তব্য করে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বুধবার নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশে নেমে না আসা পর্যন্ত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অব্যাহত থাকবে। এবারের মুদ্রানীতিতে চারটি বিষয় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে এই মুদ্রানীতি সামঞ্জস্যপূর্ণ।


বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত এই মুদ্রানীতি দেশের আর্থিক খাতকে পুনরুজ্জীবিত এবং প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সহায়তা করবে বলে মনে করছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি। একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট খাতসমূহে প্রয়োজনীয় অর্থপ্রবাহ নিশ্চিত করা ও মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখতে এবং কঠোর আর্থিকখাত নিয়ন্ত্রণের নীতিকে স্বাগত জানিয়েছে সংস্থাটি। 

বুধবার বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকে এ সংবাদ সম্মেলনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতির একটি খসড়া পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন আকারে উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. হাবিবুর রহমান। এবার বিশেষ রেপো সুদহারে (স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি-এসএলএফ) নীতি সুদহার করিডোরের ঊর্ধ্বসীমা ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়েছে, বর্তমানে তা ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এ ব্যবস্থায় সংকটে পড়া ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে কিছুটা ব্যয় কমবে।


এ ছাড়া সুদহার করিডরের নিম্নসীমা রিভার্স রেপো সুদহার (স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি-এসডিএফ) বিদ্যমান পাঁচ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে সাড়ে ছয় শতাংশ করা হয়েছে। বাজারে উদ্বৃত্ত টাকা থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক রিভার্স রেপোর মাধ্যমে টাকা তুলে নেয়। নীতি সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা ও নি¤œসীমার মধ্যে ব্যবধান ২০০ শতাংশ পয়েন্ট থেকে কমিয়ে ১৫০ শতাংশ পয়েন্টে নামিয়ে আনা হয়েছে। অর্থাৎ নীতি সুদহার আট শতাংশের সঙ্গে সর্বোচ্চ ১৫০ বেসিস পয়েন্ট যোগ করে এসএলএফ সুদহার ও নিচে ১৫০ বেসিস পয়েন্ট বিয়োগ করে এসডিএফ সুদহার নির্ধারণ করা হবে।


তারল্যের প্রয়োজনে বাণিজ্যিক ব্যাংক যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার করে, তখন তার সুদহার ঠিক হয় রেপোর মাধ্যমে। আর রিভার্স রেপোর মাধ্যমে বাংকগুলো তাদের উদ্বৃত্ত অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা রাখে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে যে সুদ হারে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেয়, তাকে বলে ব্যাংক রেট। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, চাহিদাজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ প্রশমন, বিনিময় হারের চাপ নিয়ন্ত্রণ, সরকারের কাক্সিক্ষত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে প্রয়াজনীয় অর্থের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতে ঋণ সরবরাহ নিশ্চিত করার বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে মুদ্রানীতিতে। তবে চার শতাংশের ব্যাংক রেটে পরিবর্তন আনা হয়নি।

জানুয়ারি-জুন সময়ের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে দেখা যাচ্ছে, ২০২৪ সালের জুন মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ শতাংশ। একই সময়ের জন্য সরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ২ শতাংশ; সরকারি খাতে ছিল ১৮ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে বিদেশী মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি ব্যবহারের চিন্তা করা হচ্ছে বলে জানানো হয়।


তবে এ পদ্ধতিতে ডলারের বিনিময় হার কত হবে, তা বলা হয়নি। পরে তা জানানো হবে বলে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়। মুদ্রানীতি ঘোষণার পর গভর্নর বলেন, মূল্যস্ফীতি ছয় শতাংশে নেমে না আসা পর্যন্ত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অব্যাহত থাকবে। এবারের মুদ্রানীতিতে চারটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে মনিটরিং পলিসি করা হয়েছে। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের সঙ্গে এই মুদ্রানীতি সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে প্রবৃদ্ধি এক শতাংশ কমলে অসুবিধা নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।


জানুয়ারি-জুন সময়ের জন্য সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করে গভর্নর দাবি করেছেন, আমদানিতে ডলারের দাম ১১০ টাকায় রাখা গেছে যা বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় এখনো কম, এ সময়ে আমদানি কমেছে, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বৃদ্ধির উদ্যোগ ছিল ফলে রিজার্ভ ২৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলারে রাখা গেছে। দেশে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে দাম নির্ধারণ করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, এক অর্থবছরেই ১৮ বিলিয়ন ডলার কমেছে অবকাঠামো উন্নয়নে।


এক বছরে এতটা ব্যয়ের জন্যই রিজার্ভ সংকট সৃষ্টি হয়েছে। গত তিন বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে ২৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। তবে সে অনুযায়ী ডলার আসছে না। ব্যাংকগুলো প্রয়োজনে ডলার কেনার কারণে নগদ সংকটে পড়েছে। এটাও সমাধান হয়ে যাবে।

নিজের কাজে কোনো ধরনের চাপ অনুভব করছেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, আমি কাউকে ভয় পাই না, স্বেচ্ছায় অর্থ সচিবের চাকরি ছেড়ে চুক্তিতে গভর্নরের দায়িত্ব নিয়েছি, কাজেই কোনো চাপ বা অন্য কিছুর ভয় দেখিয়ে আমাদের দিয়ে কিছু করিয়ে নেওয়া যাবে না। পাঁচ ইসলামি ব্যাংকের তারল্য সংকট নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে গভর্নর বলেন, ইসলামি ব্যাংকগুলোর কাঠামোগত কারণে তারল্য সংকট হয়েছে। তাদের সুকুক বন্ড রয়েছে টোটাল ইসলামি ব্যাংকের দুই শতাংশ।


অন্য ব্যাংকগুলোরও তারল্য সংকট ছিল তবে তাদের বন্ডে বিনিয়োগ থাকায় টাকা সরবরাহ করা গেছে। বাংলাদেশে কোনো ব্যাংক বন্ধের সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ৫২ বছরে দেশে কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়নি, আগামীতেও হবে না। তবে দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করে একীভূত করার পরিকল্পনা আছে। ব্যাংকিং খাতে গ্রাহকদের আস্থার কোনো সংকট নেই বলে এ সময় মন্তব্য করেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।


শেয়ার করুন