দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে বিএনপি। সরকারবিরোধী আন্দোলনও করেছে এক দশকের বেশি সময়। মিত্রদের নিয়ে যুগপৎ ধারার একদফার আন্দোলনেও অর্জন হয়নি নির্দিষ্ট লক্ষ্য। উলটো মামলা, হামলায় জর্জরিত লাখ লাখ নেতাকর্মী। বাড়িঘরছাড়া অনেকেই। কারাবন্দির সংখ্যাও প্রায় ২৫ হাজার ছাড়িয়েছে। সাজা হয়েছে কেন্দ্রীয় নেতাসহ বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের। ফের নির্বাচন ও নতুন সরকার গঠন করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এমন পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখছে বিএনপি। নেতাকর্মীদের চাঙা রাখতে নেওয়া হচ্ছে নানা পরিকল্পনা। ২৮ অক্টোবর-পরবর্তী সময়ের ধকল কাটিয়ে উঠতে এখন নানা কৌশলী দলটি। সাংগঠনিক দুর্বলতা শনাক্তের পাশাপাশি গণমুখী কর্মসূচি নিয়েও চিন্তাভাবনা করছেন নীতিনির্ধারকরা। সংগঠনকে শক্তিশালী করে কঠোর কর্মসূচিতে যেতে চান তারা। লক্ষ্য পূরণে ধারাবাহিক বৈঠক ছাড়াও চলমান আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের পাশে থাকবেন। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে তেমনটিই নির্দেশনা রয়েছে। বিএনপির দলীয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
দলটির স্থায়ী কমিটির এক নেতা যুগান্তরকে বলেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনে পিছিয়ে নেই বিএনপি। নির্দিষ্ট সময়ে দাবি আদায় না হলেও জনগণ ভোট বর্জন করেছে। এরপর সরকারের পতনও ঘটবে। একতরফা নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়াই ‘অবৈধভাবে’ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে। দেশে-বিদেশে এটা অবৈধ সরকার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এবার তাদের বিদায়ের পালা। বিএনপি আগের মতোই আন্দোলনে আছে। নেতাকর্মীদের চাঙা করে গণমুখী কর্মসূচি দিয়ে সরকারের পতন ঘটানো হবে। ৯ জানুয়ারি থেকে প্রতিদিনই বিএনপি ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক চলছে। এসব বৈঠকে আন্দোলনে নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন হয়েছে। পাশাপাশি সাংগঠনিক দুর্বলতাগুলো শনাক্ত হচ্ছে। শিগগিরই সংকটগুলো সমাধান করে গণমুখী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। তিনি বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ ফুঁসে উঠেছে। সারা দেশে অস্থিরতা বিরাজ করছে। যা গণতান্ত্রিক বিশ্ব নজর রাখছে। যে কোনো সময়ে যে কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। গণবিস্ফোরণের মধ্য দিয়েই দেশের গণতন্ত্র বিএনপি পুনরুদ্ধার করবে।
এদিকে নেতাকর্মীদের চাঙা রাখাসহ সাংগঠনিক শক্তি জোরদারে ধারাবাহিক বৈঠক করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও নিয়মিত ব্রিফ করছেন তিনি। শনিবার স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সারা দেশের জেলা ও মহানগরের নেতাদের সাংগঠনিক তৎপরতা বাড়াতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। আন্দোলন কর্মসূচিতে ক্ষতিগ্রস্ত নেতাকর্মীদের পাশে দাঁড়ানোর কথাও বলা হয়। রোববার ছাত্রদলের সঙ্গে বৈঠক করেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। বৈঠকে অংশ নেওয়া বিএনপির শীর্ষ এক নেতা জানান, এই মুহূর্তে মূল ফোকাস নেতাকর্মীদের চাঙা রাখা। মনোবল বৃদ্ধি করা। সংগঠনকে গতিশীল করা। বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি করা। সাংগঠনিক শক্তি সঞ্চার করেই গণমুখী কর্মসূচির দিকে অগ্রসর হওয়া। সাম্প্রতিক ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি ঘোষণা আসছে, আরও আসবে। এর মাধ্যমে ক্রমেই নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততা বাড়ানো হবে। পর্যায়ক্রমে ঢাকাসহ সারা দেশে সভা-সমাবেশের মতো কর্মসূচি আসবে। দলীয় সূত্র জানায়, সরকারবিরোধী আন্দোলনের ফসল তুলতে বিএনপিসহ প্রতিটি অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ে একাধিক নেতৃত্ব তৈরিতে মনোযোগ দিচ্ছে নীতিনির্ধারকরা। যাতে গ্রেফতার কিংবা মামলা-হামলায়ও সংগঠনের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা যায়। এছাড়া যেসব সংগঠনের নেতৃত্বে শূন্যতা রয়েছে, তা শিগগিরই সমাধান করা।
জানা যায়, ২০১৩ সাল থেকে ৩ মেয়াদে লাগাতার আন্দোলন করে আসছে বিএনপি। কোনো মেয়াদেই লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়নি । উলটো নানাভাবে কোণঠাসা। দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ারও মুক্তি মেলেনি। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কয়েকজন শীর্ষনেতা কারাবন্দি। এমন অবস্থায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে কৌশলী বিএনপি। বিগত সময়ের দুর্বলতাগুলো শনাক্ত করে সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধিতে মনোযোগ দিচ্ছেন শীর্ষনেতারা। এ নিয়ে গত কয়েকদিন দুপুর থেকে রাত ২টা পর্যন্ত বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের শীর্ষনেতাদের সঙ্গে স্কাইপিতে বৈঠক করেছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। পৃথকভাবে সাংগঠনিক বিভাগ ও জেলার শীর্ষনেতাদের সাংগঠনিক দুর্বলতা শনাক্তের নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। অঙ্গসংগঠনের নেতৃত্ব শক্তিশালী করতে পদ পুনর্গঠনের বার্তাও দিয়েছেন বিএনপি হাইকমান্ড।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘বিএনপির সাংগঠনিক শক্তি কীভাবে চলবে তা নির্ধারণ করবেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও নীতিনির্ধারকরা। এই মুহূর্তে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ও আন্দোলন একসঙ্গে চলবে। একটির জন্য আরেকটি থেমে থাকবে না। ২৮ অক্টোবরের পর যে আন্দোলন হলো-যেখানে সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কারাগারে গেছেন, সেখানে ভারপ্রাপ্ত কিংবা সক্রিয় নেতাদের দায়িত্ব দিয়ে আন্দোলন ও সংগঠন চালিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিএনপি একটা বৃহৎ রাজনৈতিক দল। কোনো কার্যক্রম থেমে থাকেনি।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক যুগান্তরকে বলেন, আগামী ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি দুই দিন জেলা ও মহানগর পর্যায়ে কালো পতাকা মিছিল কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশের যে বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকীতে ছাত্রদলের র্যালি পর্যন্ত করতে দেয়নি পুলিশ। সরকারদলীয় প্রধানের নির্দেশেই পুলিশ আগের মতো অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। সে কারণে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনে জনগণ যে ভোট বর্জন করেছে, আমরা তার ওপর নির্ভর করেই আমাদের সংগঠনকে শক্তিশালী করছি। শিগগিরই আমরা একদফার আন্দোলন আরও কঠোরভাবে জোরদার করব। আমাদের নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চলমান আছে। বিএনপি আন্দোলনেই আছে, এর মধ্যে যেখানে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করা দরকার আমরা তা করব।
ঢাকা বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ বলেন, বিএনপির ভোট বর্জনের আহ্বানে জনগণ সাড়া দিয়েছে। দেশের মানুষ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে মুখিয়ে আছে। সামনে কালো পতাকা মিছিল আছে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের নেতাকর্মীরা চাঙা হবেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যখন যে নির্দশনা দেবেন, আমরা সেটাই কার্যকর করব। সাংগঠনিক শক্তি কিংবা আন্দোলন, আমাদের নেতাকর্মীরা প্রস্তুত রয়েছে। যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু যুগান্তরকে বলেন, আগামীদিনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ বাড়াতে এই মুহূর্তে জোর দেওয়া হচ্ছে। আমাদের অনেক নেতাকর্মী কারাগারে। মামলা ও হামলায় জর্জরিত। তাদের খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে যারা অসুস্থ হয়েছেন, তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। কর্মসূচি নিয়েও আমাদের আলাপ-আলোচনা চলছে। সেই সঙ্গে বিভাগীয় পর্যায়ে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধিতে জোর দিচ্ছি। প্রতিদিনই সংগঠনের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। হাইকমান্ডের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করব।