দেশের প্রায় সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট এখন অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই)-এর ফরমেটে জাতীয় তথ্য বাতায়নের আদলে করা হয়েছে। যেখানে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার কার্যক্রম, সেবা, পরিসংখ্যান এবং দাপ্তরিক বিভিন্ন বিষয়াদির তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করা হয়। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই যে কেউ খুব সহজেই ওয়েবসাইটগুলো থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে পারেন। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের ওয়েবসাইটে এই তথ্যগুলো নিয়ে এক ধরনের লুকোচুরি দেখা গেছে। ওয়েবসাইটটি এখনো রয়ে গেছে পুরোনো ফরমেটে। তারা জাতীয় তথ্য বাতায়নের আদলে ওয়েবসাইট নির্মাণ করেনি। এতে ওয়েবসাইটে অপরাধ পরিসংখ্যানসহ সাধারণ অনেক তথ্যও মেলে না। অনেক তথ্য গোছানোভাবে উপস্থাপন না করে বিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত করা হয়েছে। ফলে সহজেই অনেক সেবা ও তথ্য লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নাগরিকরা। বছরজুড়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দফায় দফায় ওয়েবসাইট হালনাগাদের নির্দেশনা দিলেও এটি সংস্কার করা হয়নি।
গত বছরের ২৪ মে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অধীন অধিদপ্তর ও সংস্থাসমূহের এক সমন্বয় সভা হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, দপ্তর ও সংস্থাগুলোর ওয়েবসাইট হালনাগাদ করতে হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই বছরের ২০ জুনের মধ্যে এটুআই ফরমেট অনুযায়ী প্রয়োজনীয় তথ্য সংযোজন ও হালনাগাদ করার কথা। পুলিশের সংশ্লিষ্টরা নির্ধারিত সময়ে সেটি করেননি। পরবর্তীতে ২২ জুন জননিরাপত্তা বিভাগের আরেক সমন্বয় সভায়ও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানেও সিদ্ধান্ত হয়, দপ্তর ও সংস্থার অর্জন ও কার্যাবলি ওয়েবসাইটের মেনুবারে সংযোজন করতে হবে। প্রয়োজনীয় তথ্য আপডেট করার জন্য সবাইকে পত্র দিতে হবে। সর্বসাধারণের উপযোগী করতে ওয়েবসাইটে বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন রাখতে হবে। পরের মাস জুলাইয়ের ২০ তারিখ জননিরাপত্তা বিভাগের মাসিক সমন্বয় সভায় পুলিশের ওয়েবসাইটটি হালনাগাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এজন্য পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে জননিরাপত্তা বিভাগের সিস্টেম অ্যানালিস্টের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে কাজটি করতে বলা হয়। এরপর থেকে প্রায় প্রতি মাসের সমন্বয় সভাতেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু পুলিশের ওয়েবসাইট আর হালনাগাদ হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (আইসিটি) ইসতিয়াক-উর-রশিদ যুগান্তরকে বলেন, ওয়েবসাইটটি হালনাগাদে আমরা কাজ করছি। ইতোমধ্যে কিছু কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আমরা এটিকে পুরোপুরি জাতীয় তথ্য বাতায়নের আদলে তৈরি করব। পুলিশের সব ইউনিটের ওয়েবসাইট মূল ওয়েবসাইটের সঙ্গে এটুআই ফরমেটে যুক্ত করা হবে।
এটুআই ফরমেটে সাধারণত একটি ওয়েবসাইটে সংশ্লিষ্ট দপ্তর, কর্মকর্তা, সিটিজেন চার্টার, বিজ্ঞপ্তি, পরিপত্র, নোটিশ, প্রজ্ঞাপন, জি.ও, অফিস আদেশসহ নানা বিষয় থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-নিয়োগ/বদলি/পদোন্নতি, প্রশিক্ষণ/সভার নোটিশ, অনাপত্তি সনদ/অর্জিত ছুটি, পিআরএল ও পেনশন সংক্রান্ত, জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল, সেবা প্রদান প্রতিশ্রুতি (সিটিজেনস চার্টার), বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি, অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্থাপনা। এতে আরও উল্লেখ থাকে-তথ্য অধিকার, উদ্ভাবনী কার্যক্রম, বাজেট ব্যবস্থাপনা, নীতিমালা ও প্রকাশনা, আইন ও বিধি, বার্ষিক প্রতিবেদন, বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ফরম, ছবি ও ভিডিওর গ্যালারি, এসডিজি, লক্ষ্যমাত্রা ও সূচকসমূহ। এর বাইরে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো তাদের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় যেমন-কাজের পরিসংখ্যান, উন্নয়ন কাজের পরিসংখ্যান, মামলার পরিসংখ্যানসহ এ ধরনের তথ্য উল্লেখ করে থাকে। যার বেশির ভাগই পুলিশের ওয়েবসাইটে অনুপস্থিত।
পুলিশের বর্তমান ওয়েবসাইটটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এটি ইংরেজি ভাষায় করা। এর কোনো বাংলা ভার্সন নেই। পুলিশের ইউনিটগুলো সম্পর্কে কিছু তথ্য রয়েছে। তবে সেখানে আবার সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোর ওয়েবসাইটের লিংক যুক্ত করা হয়নি। সম্প্রতি এটুআই ফরমেটে নয়টি মেনুবার সংযুক্ত করা হলেও এতে তেমন কোনো তথ্য নেই। বছর পাঁচেক আগেও পুলিশের ওয়েবসাইটে সব ধরনের অপরাধের পরিসংখ্যান দেওয়া হতো। সেখানে এলাকাভিত্তিক অপরাধের হিসাব থাকত। ফলে গণমাধ্যমকর্মীসহ সংশ্লিষ্টরা এই পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করতে পারত। অপরাধের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পেত। সেটিও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন আর এ সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য ওয়েবসাইটটিতে দেওয়া হয় না। এমনকি সুনির্দিষ্ট অপরাধের তথ্য চাইলেও তা দিতে গড়িমসি এবং বিলম্ব করার অভিযোগ পুলিশের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) ইনামুল হক সাগর যুগান্তরকে বলেন, জননিরাপত্তা বিভাগের নির্দেশনা অনুযায়ী ওয়েবসাইটটি তৈরির কাজ চলমান। অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিতে আমরা সবসময় আন্তরিকভাবে কাজ করি।
এদিকে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটেও এটুআই ফরমেটে ওয়েবসাইট তৈরিতে অনীহা দেখা গেছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশসহ অধিকাংশ মেট্রোপলিটন পুলিশ নিজস্ব ওয়েবসাইট ব্যবহার করছে। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) নিজস্ব ওয়েবসাইট রয়েছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তাদের ওয়েবসাইটে এটুআইর ফরমেটে কিছু মেনুবার যুক্ত করলেও তা যথাযথভাবে হালনাগাদ করে না। এন্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিইউ) ওয়েবসাইটেও এটুআই ফরমেট অনুসরণ করা হয়নি। এছাড়া ব্যাটালিয়ন পুলিশের আলাদা কোনো ওয়েবসাইট পাওয়া যায়নি। অবশ্য এপিবিএন ও এসপিবিএন’র বিভিন্ন ইউনিটের নিজস্ব কিছু ওয়েবসাইট রয়েছে।
রেলওয়ে পুলিশেরও পৃথক কোনো ওয়েবসাইট পাওয়া যায়নি। তবে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের ওয়েবসাইট তুলনামূলকভাবে অনেক গোছানো। তবে এটিও নিয়মিত জাতীয় তথ্য বাতায়নের আদলে হালনাগাদ হয় না। হাইওয়ে পুলিশের ওয়েবসাইটেও জাতীয় তথ্য বাতায়নের আদলে প্রায় সব ধরনের মেনুবার রয়েছে। তবে সড়ক দুর্ঘটনা ও অপরাধ পরিসংখ্যানসহ অনেক তথ্য নিয়মিত আপডেট করা হয় না। ট্যুরিস্ট পুলিশের ওয়েবসাইটের অবস্থাও অনেকটা একই রকম।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে অপরাধের পরিসংখ্যানসহ বিভিন্ন সেবার বিষয়গুলো ওয়েবসাইটে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা উচিত। এতে সাধারণ মানুষ সহজেই পুলিশের সেবাগুলো পাবে। পাশাপাশি অপরাধপ্রবণতা নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি অংশীজনরাও কাজ করতে পারবে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক যুগান্তরকে বলেন, প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে তথ্য গোপনের প্রবণতা ইতিবাচক বিষয় নয়। রাষ্ট্র যখন ডিজিটালাইজড হচ্ছে, তখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীরও এই দিকটিতে সমানতালে এগিয়ে যেতে হবে। দেশে কোন ধরনের অপরাধের গতি-প্রকৃতি কী রকম-সাধারণ মানুষের সেটি জানার অধিকার রয়েছে। পুলিশের হয়তো এ ক্ষেত্রে এক ধরনের পেশাগত ভয় আছে। তারা মনে করে, এগুলো প্রকাশ পেলে তাদের হয়তো অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে। কিন্তু বর্তমানে এই ধারণা একেবারেই সঠিক নয়। বরং অপরাধ পরিসংখ্যানসহ এ সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে যত বেশি আলোচনা হবে, তত বেশি অপরাধ কমিয়ে আনার পরিবেশ তৈরি হবে। এজন্য পুলিশের অবশ্যই উচিত ওয়েবসাইট আপডেট করে এ সংক্রান্ত সব তথ্য সন্নিবেশ করা।