২৮ এপ্রিল ২০২৪, রবিবার, ০৪:৩০:১৭ অপরাহ্ন
ডলার সংকটের প্রভাব উৎপাদন-বিনিয়োগে
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-০২-২০২৪
ডলার সংকটের প্রভাব উৎপাদন-বিনিয়োগে

দেশে দুই বছরের বেশি সময় ধরে ডলার সংকট চলছে। সংকটের কারণে ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা প্রয়োজনীয় এলসি খুলতে পারছেন না। ফলে সার্বিক আমদানিসহ শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি, মধ্যবর্তী পণ্য ও কাঁচামাল আমদানির এলসি খোলা কমছে। এমন পরিস্থিতিতে সব শিল্পেরই উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বেসরকারি বিনিয়োগ ও রপ্তানিতে। এতে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিও কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।


অন্যদিকে সংকটকে পুঁজি করে দীর্ঘদিন ধরেই ডলার বাজারে অস্থিরতা চলছে। এ সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার প্রকৃত অবমূল্যায়ন হয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। আর ডলারের দামের এই লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়েছে। এর প্রভাবে চড়েছে পণ্যের দাম, উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে কষ্ট বেড়েছে সাধারণ মানুষের। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমার ও মূল্যস্ফীতি বাড়ার পূর্বাভাস দিয়েছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে ডলার সংকটের কথা বলা হয়েছে।


অর্থনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের শিল্প উৎপাদনের বেশির ভাগই আমদানির ওপর নির্ভরশীল। ফলে ডলার সংকটের দ্রুত সমাধান না হলে আমদানি ও উৎপাদন পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। এতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।


মহামারী করোনা পরিস্থিতি উন্নতির পর অর্থনীতিতে চাহিদা বৃদ্ধি ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ২০২২ সালের মার্চ থেকে দেশে ডলার সংকট দেখা দেয়। ওই বছরের মে মাস থেকে এই সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। এর ফলে কমতে থাকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এরপর থেকে রিজার্ভ সাশ্রয়ে আমদানিতে নানা কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। তখন থেকে এলসি খুলতে প্রয়োজনীয় ডলার পাচ্ছেন না ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা। এর বাইরে চিকিৎসা, শিক্ষা, ভ্রমণসহ বিভিন্ন কাজে বিদেশ ভ্রমণের জন্য অনেকে ডলার পাচ্ছেন না। ডলার সংকটের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমে এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে।


বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, অর্থনৈতিক ঝুঁকি সামাল দিতে সবচেয়ে ‘ধারালো অস্ত্র’ হলো বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ। ডলার সংকটের কারণে সেই রিজার্ভ কমে যাওয়ায় অর্থনীতিতে চাপ বাড়ছে। অর্থনীতির এই সংকট কাটাতে হলে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। এ জন্য বৈদেশিক মুদ্রাবাজার আরেকটু উদার করা যেতে পারে। পাশাপাশি বাজেট ব্যবস্থাপনায় আরও সাশ্রয়ী হতে হবে। সেই সঙ্গে রাজস্ব আহরণে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। রাজস্ব ও ভ্যাট ফাঁকি বন্ধ করতে হবে।


টানা কমছে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য এলসি নিষ্পত্তি কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ। এ সময়ে ৩ হাজার ৩৬৮ কোটি ডলারের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে। গত অর্থবছর আমদানি এলসি ১৬ শতাংশের মতো কমে হয়েছিল ৬ হাজার ৯৫০ কোটি ডলার। এবার সবচেয়ে বেশি কমেছে শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি। ডিসেম্বর পর্যন্ত শিল্পের কাঁচামালের এলসি ৩১ শতাংশের বেশি কমে ১ হাজার ৫৪ কোটি ডলারে নেমেছে। মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তি প্রায় ২৭ শতাংশ কমে ১৪৩ কোটি ডলারে নেমেছে। এ ছাড়া শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্যের এলসি খোলা কমেছে ১০ শতাংশের মতো।


এ বিষয়ে বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক যে সংকট চলছে, সেটার রেশ বাংলাদেশেও আছে। তবে ডলার সংকটই ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের বেশি ভোগচ্ছে। যার প্রভাব পড়েছে আমদানি ও রপ্তানিতে। আমদানি এলসি খোলার জন্য প্রয়োজনীয় ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। আরেকটা কারণ জ্বালানি সংকট। এর ফলে শিল্পের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমছে। অনেক কারখানায় কাঁচামাল সংকটে উৎপাদনও কমে গেছে। এ ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগে কেউ যেতে চাইছে না।


রপ্তানি আয়েও ধীরগতি: ডলার সংকটের কারণে রপ্তানি খাতের জন্য খোলা ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলার হারও কমছে। এর প্রভাব পড়ছে রপ্তানিতেও। ইপিবির তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১ শতাংশেরও কম। এর মধ্যে একক মাস হিসেবে ডিসেম্বরে প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ধারায় নেমেছে। গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রপ্তানি আয়ে ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। এর মধ্যে ডিসেম্বরে ৯ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়। এ বিষয়ে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে রপ্তানি আয়ের যে ডাটা প্রতি মাসে প্রকাশ করা হচ্ছে, সেখানে প্রকৃত চিত্র আসছে না। ইপিবির তথ্যে রপ্তানি আয়ে যে প্রবৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে, বাস্তবে সেই হারে রপ্তানি বাড়ছে না।


নির্ধারিত দামে ডলার মিলছে না: প্রায় ১৬ মাস ডলারের দাম নির্ধারণের ক্ষমতা ব্যাংকের কাছে ন্যস্ত করার পরও বাজারে শৃঙ্খলা ফেরেনি। নির্ধারিত দামের চেয়ে এখনো ১২ থেকে ১৫ টাকা বেশি দামে ডলার বিক্রি হচ্ছে। আমদানিতে ডলারের দর ১১০ টাকা ঠিক করা হলেও ব্যবসায়ীদের কিনতে হচ্ছে ১২২ থেকে ১২৫ টাকা। এ রকম বাস্তবতায় আইএমএফের পরামর্শে শিগগিরই ‘ক্রলিং পেগ’ নামে ডলার বেচাকেনার নতুন পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ উপায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের একটি মধ্যবর্তী দর ঠিক করবে। তার সঙ্গে সর্বোচ্চ বৃদ্ধি ও হ্রাসের দর নির্ধারণ করা হবে। নির্ধারিত দামে ডলার পাচ্ছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আমরা রপ্তানিকারকরা যে ডলার আনি, সেই ডলার ব্যাংকগুলো কিনছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সায়। কিন্তু আমরা যখন আমদানির জন্য ডলার চাচ্ছি, তখন সেই ডলারেরই দাম নেওয়া হচ্ছে ১২০ থেকে ১২৫ টাকা।


কমবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি: চলতি অর্থবছরের জন্য বাজেটে সাড়ে ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এরই মধ্যে এ হার সংশোধন করে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গত মাসে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টাস-২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির হার কমার কারণ সম্পর্কে বলা হয়, বিধিনিষেধের কারণে একদিকে আমদানি কম হয়েছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন উপাদান ও জ্বালানি উপকরণের দাম বেড়েছে। এ ছাড়া বৈশ্বিক ও দেশীয় আর্থিক চাপ তো আছেই। এসব কারণে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকা-ের গতি কমেছে। আমদানিতে বিধিনিষেধ সামনেও অব্যাহত থাকবে। এসব কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। এ কারণে প্রবৃদ্ধির হারও কম হবে।


পণ্যমূল্য বেড়ে ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতিও: চলতি অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশে সীমিত রাখার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। এটি সংশোধন করে তা সাড়ে ৭ শতাংশে রাখার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকও বলছে, চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার বাড়তে পারে। কারণ ব্যক্তিগত খরচের ওপর ভর করে এ খাতে চাপ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিবিএসের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের নভেম্বরে হয়েছে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আগের মাস অক্টোবরে যা ছিল ৮ দশমিক ৯১ শতাংশ। তবে গত মে মাসে মূল্যস্ফীতি উঠেছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ, যা ১৩৪ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। এর আগে ২০১২ সালের মার্চে ১০ দশমিক ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছিল। এরপর আর কখনো মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে যায়নি।


শেয়ার করুন