২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ০১:৩৬:০১ অপরাহ্ন
চাকরির বাজারে বেকারের সারি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২২-০২-২০২৪
চাকরির বাজারে বেকারের সারি

অর্থনীতি বড় হচ্ছে। বেসরকারি খাতের ব্যাপক প্রসার ঘটছে। সরকারও উন্নয়ন খাতে প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ করছে। এসবে ভর করে বাড়ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি। সরকার দাবি করছে, সার্বিকভাবে দেশের উন্নয়ন হওয়ায় বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাচ্ছে। তবে এত ভালো খবরের ভিড়ে হতাশাজনক খবর হলো, এই মুহূর্তে দেশে ২৩ লাখের বেশি বেকার চাকরি খুঁজছেন। গত বছরের শেষ তিন মাসেই বেকার বেড়েছে ৪০ হাজার। বেকারদের মধ্যে আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের অন্তত ২৮ শতাংশ বেকার রয়েছেন। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ডলারসহ নানা সংকটের কারণে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্থর গতি চলছে। তার প্রভাবেই চাকরির বাজারও কিছুটা সংকুচিত।


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভিদবিজ্ঞানে ২০১৮ সালে স্নাতক ও ২০১৯ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন আরিফুল ইসলাম। লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর থেকেই চাকরির চেষ্টা করে যাচ্ছেন জানিয়ে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কোনোটার প্রিলিমিনারি পাস করি তো লিখিত পরীক্ষায় আটকে যাচ্ছি। আবার কখনো সেটা উতরে গেলে ভাইভাতে আটকে যাচ্ছি।’


আরিফুল ইসলাম আরও বলেন, প্রতিযোগিতা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছরই হাজার হাজার ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছেন। বেসরকারি খাতে চাকরির জন্য অনেক ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞতার প্রয়োজন পড়ে। ফলে চাকরিতে কোথাও ঢুকতে না পারলে অভিজ্ঞতা হয় না। অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে চাকরি হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষিত আরিফের মতো এ রকম অসংখ্য তরুণ বেকারেরই চাকরি না পাওয়া নিয়ে এমন হতাশার গল্প রয়েছে।


জানা যায়, দেশে ডলার, বিদ্যুৎ-জ্বালানি সংকটসহ নানা কারণে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কম। আমদানি কড়াকড়ি করায় শিল্পের যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল আমদানি কমছে। এতে নতুন শিল্প স্থাপন, বিদ্যমান শিল্পের প্রসার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এতে নতুন কাজের সুযোগ কমছে। আর সঙ্গে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে সুদের হার বাড়িয়ে টাকার প্রবাহ কমানোর কারণে ব্যবসা ও শিল্পের প্রসার স্লথ হয়ে পড়ছে বলে উদ্যোক্তারা দাবি করেছেন। তাঁরা মনে করেন, এতে চাকরির সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষিতরা সহসাই চাকরিতে ঢুকতে পারছেন না। আর সরকারও উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যাপক বিনিয়োগ পরিকল্পনা করলেও ঠিকমতো প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সামনে এডিপির আকারও কাটছাঁট করা হবে বাস্তবায়ন অদক্ষতা ও পর্যাপ্ত তহবিলের অভাবে। এর ফলেও বেকার জনগোষ্ঠীর একটি অংশের কাজ পেতে সমস্যা হচ্ছে। পোশাক, বস্ত্র, চামড়া ও হালকা প্রকৌশল খাতের অনেক উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁদের অনেকেই ব্যবসা বাড়াচ্ছেন না, বরং পর্যাপ্ত পুঁজির অভাব ও খরচ বেড়ে যাওয়ায় কিছু জনবল কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআই প্রবাহ কমেছে ৩৬ শতাংশ।


সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সব শেষ তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে জানা যায়, সংস্থার শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, গত বছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে দেশে বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৩ লাখ ১০ হাজার। এর মধ্যে ৮৩ শতাংশই তরুণ-তরুণী।


তথ্য-উপাত্ত বলছে, শ্রমশক্তিতে ২ কোটি ৬৮ লাখ ২৪ হাজার যুবক-যুবতী আছেন, যাঁদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছর। তাঁদের মধ্যে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৭৫ হাজার কাজের মধ্যে আছেন। যুবক-যুবতীদের মধ্যে ২১ লাখ ৪৮ হাজার বেকার, যা দেশের মোট বেকার জনগোষ্ঠীর ৮৩ শতাংশ।


বিবিএসের মতে, সাত দিনে কমপক্ষে এক ঘণ্টাও কোনো কাজ করেনি, কিন্তু কাজের জন্য প্রস্তুত ছিলেন, তাঁদেরই বেকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এমনকি জরিপের আগে ৩০ দিন বেতন বা মজুরি বা মুনাফার বিনিময়ে কাজ খুঁজেছেন, তাঁরাও বেকার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।


পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরে কমপক্ষে ২০ লাখ মানুষ চাকরির বাজারে প্রবেশ করেন। তাঁদের ১৩-১৪ লাখের দেশের অভ্যন্তরে কর্মসংস্থান হয়। বাকিটা দেশের বাইরে যান।


নিট পোশাকমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ ও এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফজলুল হক বলেন, ‘কর্মসংস্থান হচ্ছে না এটা ঠিক। অনেকের ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়, কাটছাঁট করে ব্যবসায় টিকে থাকার চেষ্টা করছেন। তবে দেশে কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট আছেন কমই। যে ধরনের লোক আমরা চাই, সেই ধরনের লোক নেই। আমাদের প্রয়োজনের সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার একটা দূরত্ব রয়ে গেছে। এ কারণে প্রচুর বিদেশি লোকজন এখানে চাকরিতে ঢুকছেন। শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো গেলে আমাদের চাকরি হবে, বিদেশি লোকজনের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে, বৈদেশিক মুদ্রাও বাঁচবে।’


বিবিএসের হিসাবে চাকরি করার মতো উপযুক্ত বেকারের বাইরেও দেশের বড় একটি জনগোষ্ঠী শ্রমশক্তির বাইরে রয়েছে। এ সংখ্যাটি প্রায় ৪ কোটি ৭৪ লাখ। যাঁদের বড় অংশই শিক্ষার্থী, অসুস্থ, অবসরপ্রাপ্ত বা বয়স্ক লোক।


গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা দেশের বিভিন্ন কলেজ থেকে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৮ শতাংশ বেকার অবস্থায় আছেন। তাঁরা খুঁজছেন, কিন্তু চাকরি পেতে বেগ পেতে হচ্ছে।


জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা উচ্চশিক্ষিতদের একটি বড় অংশ বেকার কেন–এ বিষয়ে জরিপ পরিচালনা করা বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. এস এম জুলফিকার আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, তাঁদের সম্পর্কে চাকরিদাতাদের একটু নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তা ছাড়া, ওই বেকারদের নিজের বিষয়ের বাইরেও জানা-বোঝা বা অন্য কিছু বিষয়ে দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। তিনি বলেন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা একটি বড় শ্রেণি চাকরির অপেক্ষায় থাকা সত্ত্বেও পোশাকশিল্পসহ এ রকম কয়েকটি খাতে বিদেশিদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এটাও বেকারত্বের একটি কারণ। তাঁর মতে, উদ্যোক্তারা মনে করেন, দেশের শিক্ষিতদের একটি অংশের উৎপাদনশীলতা কম এবং যে ধরনের কাজে তাঁরা লোক খুঁজছেন, তাঁরা ওই কাজের জন্য উপযুক্ত নন।


শেয়ার করুন