২২ নভেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ০১:৪৩:০৮ পূর্বাহ্ন
বিদ্যুৎ বাড়াবে খরচের বোঝা
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৮-০২-২০২৪
বিদ্যুৎ বাড়াবে খরচের বোঝা

নিত্যপণ্যের চড়া মূল্যে এমনিতেই চাপে সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা জানিয়েছে সরকার। বিদ্যুতের নতুন দাম কার্যকর হবে আগামী মাস (মার্চ) থেকে। বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দামও, যা কার্যকর হবে চলতি ফেব্রুয়ারি থেকেই। তবে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ছে না এখনই।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুতের বাড়তি দাম মানুষের খরচ আরও বাড়িয়ে জীবনযাপনে নতুন চাপ সৃষ্টি করবে। মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতেই নিত্যপণ্যের দাম ২০ শতাংশ বেড়েছে। বিদ্যুতের বাড়তি দামের প্রভাব যোগ হবে নিত্যপণ্যের বাজারে। শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়ায় এগুলোর দামও বাড়বে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আরেক দফা কমাবে।


বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর কথা গতকাল মঙ্গলবার সকালে জানান বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি সর্বনিম্ন ৩৪ থেকে ৭০ পয়সা বাড়তে পারে, যা মার্চ থেকে কার্যকর হচ্ছে। ভর্তুকি সমন্বয়ে বিদ্যুতের সঙ্গে গ্যাসের দামও বাড়ানো হচ্ছে।


প্রতিমন্ত্রী এসব জানানোর পর বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার করা গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটারে ৭৫ পয়সা বাড়িয়ে গেজেট জারি করে মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়েছে, গ্যাসের নতুন দাম চলতি মাস থেকেই কার্যকর হবে।


ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিদ্যুৎ ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহারের গ্যাসের দাম বাড়লে উৎপাদন খরচ বাড়বে। ব্যবসায়ীদের চাওয়া ছিল শিল্পকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎপ্রাপ্তি। এটি করা গেলে তেমন সমস্যা হবে না।


গত বছরের ১৮ জানুয়ারি আবাসিক, সিএনজিচালিত যানবাহন, সার ও চা-শিল্পে ব্যবহার ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছিল সরকার। তখন প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম করা হয় ১৪ টাকা। এবার প্রতি ঘনমিটারে ৭৫ পয়সা বাড়ানোয় দাম হচ্ছে ১৪ টাকা ৭৫ পয়সা। ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্ট, স্মল পাওয়ার প্ল্যান্ট ও বাণিজ্যিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ছিল প্রতি ঘনমিটার ৩০ টাকা। এর নতুন দাম ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা।


খুচরায় ৫ শতাংশ বাড়িয়ে বিদ্যুতের সর্বশেষ দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, যা পরের মাসে কার্যকর হয়। ওই দর অনুযায়ী খুচরায় গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম হয় ৮ টাকা ২৪ পয়সা, যা ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৭ টাকা ৮৫ পয়সা ছিল। জানুয়ারিতে ছিল ৭ টাকা ৪৮ পয়সা। তিন মাসের মধ্যে তিন দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল।


মন্ত্রণালয়ের দাবি অনুযায়ী, দেশে এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ২৬ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। কিন্তু গ্রীষ্মকালে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ১৩ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। শীতে তা কমে আসে ৮ থেকে ৯ হাজার মেগাওয়াটে। কিন্তু উৎপাদন না করলেও বসে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বিপুল অঙ্কের কেন্দ্র ভাড়া দিতে হয় সরকারকে, যা ক্যাপাসিটি চার্জ নামে পরিচিত।


বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী বলেন, সব গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দামের সমন্বয় হচ্ছে না। বিদ্যুৎ উৎপাদন পর্যায়ে হচ্ছে। আবাসিক পর্যায়ে ও শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ছে না। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে যে গ্যাস দেওয়া হয়, সেখানে কিছুটা সমন্বয় করা হচ্ছে। দাম বাড়ানোর প্রেক্ষাপট জানিয়ে তিনি বলেন, এ বছর বিদ্যুতে ৪৩ হাজার কোটি এবং জ্বালানিতে ৬ হাজার কোটি টাকার মতো ভর্তুকি দিতে হবে। এগুলো আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সমন্বয় করা হবে। যেকোনো দেশে জ্বালানির ওপরই বিদ্যুতের দাম ওঠানামা করে। কাজেই এর সঙ্গে সমন্বয় ছাড়া উপায় নেই।


বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন ভোক্তা-অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম। তিনি বলেন, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম সরকার নির্বাহী আদেশে বাড়াচ্ছে। এসব খাতে যাঁরা বিনিয়োগ করছেন, তাঁরা একচেটিয়া ব্যবসা করছেন। বিদ্যুৎ উৎপাদনের চেয়ে আমদানি খরচ কম পড়ছে। সব মিলিয়ে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা ভয়ংকর হুমকিতে।


বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ার প্রভাব নিত্যপণ্যের বাজারে পড়বে। নিত্যপণ্যের দাম এমনিতেই চড়া।


জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, রমজানের আগে বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়ানোয় পণ্যের দামে সাংঘাতিক প্রভাব পড়বে। সব মিলিয়ে বাড়তি খরচের চাপ সামলাতে আরও হিমশিম খাবেন ভোক্তারা। তবে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম জুনের পর বাড়ালে সাধারণ মানুষের জন্য ভালো হতো।


তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বলেন, সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়বেই। কারণ ঋণ ও আমদানিনির্ভর গ্যাস-বিদ্যুৎ ব্যবহার করায় দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। এলএনজি আমদানি ও ক্যাপাসিটি চার্জের বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। একই সঙ্গে দেশি-বিদেশি চুক্তি বাতিল করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং দেশে তেল-গ্যাসের সন্ধান করে তা ব্যবহার করতে পারলেই দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে।


শেয়ার করুন