অভিজ্ঞতা সনদ জালিয়াতির কারণে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগে ১৩৮টি দরপত্র বাতিল করা হয়েছে। এসব দরপত্রের আওতায় প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার কাজ ছিল। যার বেশিরভাগ সড়ক সংস্কার। অক্টোবরে পর্যায়ক্রমে এসব দরপত্র বাতিল করা হয়। এখন বিধি মোতাবেক জড়িত ঠিকাদারদের কালো তালিকাভুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যদিও প্রভাবশালী ঠিকাদারদের টিকিটি স্পর্শ করতে পারছে না সওজ।
এদিকে জাল-জালিয়াতির কারণে দরপত্র বাতিল করায় নিয়মানুযায়ী নতুন করে দরপত্র আহ্বান করতে হবে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোর কাজ শুরু হতে যেমন দেরি হবে, তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে দর বাড়ার আশঙ্কাও রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সওজের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মইনুল হাসান যুগান্তরকে বলেন, ‘এটি অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ নিয়ে কথা বলতে চাই না।’
সূত্র জানায়, পিএমপি (পিউরিক ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম) খাতে সড়ক সংস্কার ও সেতু-কালভার্ট নির্মাণসহ এডিবির আওতায় নেওয়া এসব কাজ হাতিয়ে নিতে বেশি তৎপর ছিল প্রভাবশালীরা। আবার অভিজ্ঞতা সনদ জালিয়াতিতে এরাই রয়েছে সামনের সারিতে। যখন কাজ শুরু হওয়ার কথা তখন আবার পুনঃদরপত্র আহ্বান করতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ অবস্থায় সময়মতো কাজ সম্পন্ন না হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে সওজ। আগামী ৫ মাসেও এই কাজ শুরু করা যাবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। বাস্তবে সেরকম পরিস্থিতি দেখা দিলে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় গ্রামমুখী লাখ লাখ মানুষের আনন্দময় স্বাভাবিক ঈদযাত্রা অনেক সড়কে ব্যাহত হবে। কারণ এসব কাজের মধ্যে বেশিরভাগ হলো সড়ক সংস্কারের কাজ। এছাড়া ওই সময় থাকবে পুরো বর্ষাকাল। ফলে কাজের গতি ব্যাহত হওয়া ছাড়াও সংস্কার কাজের মান বজায় রাখা কঠিন হবে।
নথিপত্রে দেখা গেছে, সওজের ১০টি জোনে পিএমপির আওতায় সারা দেশে সড়ক সংস্কারে ৭০টি কাজের দরপত্র হয় অক্টোবরে। এতে ব্যয় ধরা হয় ৮৩৪ কোটি ৮১ লাখ টাকা। এছাড়া সেতু ও কালভার্ট নির্মাণে ১২১টি দরপত্রে ব্যয় ধরা হয় ৬৩৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা। আরএডিবির আওতায় উন্নয়ন খাতে সওজের ঢাকা জোনে ২শ কোটি, ময়মনসিংহ জোনে ১৫০ কোটি, চট্টগ্রাম জোনে ৫০ কোটি, খুলনা জোনে ১৫০ কোটি, কুমিল্লা জোনে ৩৯শ কোটি, বরিশাল জোনে ১৫০ কোটি, গোপালগঞ্জ জোনে ৩৫০ কোটি, রংপুর জোনে ২৫০ কোটি এবং সিলেট জোনে ২৭শ কোটি টাকার কাজ হাতে নেয় সওজ। এর মধ্যে কুমিল্লা ও সিলেটে এই অর্থবছরে সবচেয়ে ব্যয়বহুল কাজ হাতে নেওয়া হয়। ঠিকাদারদের জালিয়াতির কারণে এই দুটি জোনে ৫ হাজার ৪শ কোটি টাকার টেন্ডার প্রক্রিয়াই গ্রহণ করেনি। সব মিলে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকারও বেশি কাজ সময়মতো বাস্তবায়ন না হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
জানা গেছে, স্বচ্ছ দরপত্র মূল্যায়নে এর আগে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ও সওজকে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। টিডিএমএস (টেন্ডার ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম) এবং টিসিআইএস (টেন্ডার অ্যান্ড কন্ট্রাক্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) দুটি হচ্ছে দরপত্র মূল্যায়নে পরীক্ষামূলক সফটওয়্যার। ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই দরপত্র মূল্যায়নে এই সফটওয়্যার ব্যবহারের সম্মতি দেয় সিপিটিইউ। অথচ সওজের দুর্নীতিবাজ প্রকৌশলীদের দরপত্র মূল্যায়নে পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ দিতে এই সফটওয়্যার ত্রুটিপূর্ণ করে রাখা হয়েছে। সাড়ে ৬ বছর অতিবাহিত হলেও ডিজিটাল এই প্রক্রিয়া পূর্ণাঙ্গভাবে সম্পন্ন করতে পারেনি সওজ।
এ বিষয়ে একাধিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিপিটিইউতে লিখিত অভিযোগ দিয়ে বলেছে, টিডিএমএস ও টিসিআইএস সফটওয়্যারের মাধ্যমে সওজের এসব বিতর্কিত কর্মকর্তা তাদের পছন্দের ঠিকাদারকে অনৈতিক উপায়ে কাজ পাইয়ে দেওয়ার ভূমিকা পালন করেন। এবার ঠিকাদারদের অভিজ্ঞতা সনদ জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়লে দরপত্র মূল্যায়ন স্থগিত হয়ে পড়ে। এ কারণে সওজে অচলাবস্থা তৈরি হয়।
সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, কাজ বাগিয়ে নেওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা সওজে দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। এর প্রতিকার নিয়ে মন্ত্রণালয়েও দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। কিন্তু সওজের প্রধান প্রকৌশলীসহ গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা বিষয়টি সব সময়ই এড়িয়ে গেছেন। কারণ, কয়েকজন ঠিকাদারের কাছে জিম্মি হয়ে গেছেন পালের গোদা দুর্নীতিবাজ কয়েকজন কর্মকর্তা। যে কারণে ঠিকাদারদের লাগাম টেনে ধরার দায়িত্ব যাদের হাতে বর্তায় তারাই এতে আশকারা দিয়েছেন। জনস্বার্থে ওই কর্মকর্তা ২০২২ সালের ১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত এ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ সভার কার্যবিবরণীর ফটোকপি প্রতিবেদকের হাতে তুলে দেন।
এতে দেখা গেছে, ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন সড়ক পরিবহণ ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব একেএম শামীম আক্তার। ওই সভায় তিনি বলেন, ‘সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পণ্য ও সেবা ক্রয়ে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে একই প্রতিষ্ঠান একাধিক কাজ পেলে অনেক সময় দেখা যায় কাজ যথাসময়ে শেষ করতে পারছে না। এসব ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একই প্রতিষ্ঠানকে একই সঙ্গে দুটি কাজের বেশি না দেওয়ার বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
সভায় তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেখা যায়, ক্রয়কাজে উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে (ওটিএম) সব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যদি ১০ ভাগ কম মূল্যে সমান দর দাখিল করে তবে ব্যবস্থাটাই এমন যে, একজন দরদাতা প্রতিটি দরপত্রে বিজয়ী হতে পারেন। কারণ অতীত কাজের অভিজ্ঞতাকে এমনভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, সওজে সীমিত দরপত্র পদ্ধতি থাকলে কিছু সংখ্যক ঠিকাদারের কাজের সংখ্যা বৃদ্ধির সুযোগ সীমিত হবে। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে একই ঠিকাদারের অধিক সংখ্যক কাজ পাওয়ার প্রবণতা হ্রাস পাবে।
কাজ পাওয়ার নমুনা : ওই সভায় সওজের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (প্রকিউরমেন্ট সার্কেল) মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সড়ক ও জনপথে তিন পদ্ধতিতে কাজের দরপত্র আহ্বান করা হয়। এগুলো হচ্ছে-দৈনন্দিন রক্ষণাবেক্ষণ, পর্যায়ক্রমে রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নমূলক কাজ। পর্যায়ক্রমে রক্ষণাবেক্ষণ কাজের মধ্যে ছোট ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় (পিএমপি) বড় কাজ রয়েছে। সারা দেশে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজারের মতো ছোট কাজ নেওয়া হয়। এরমধ্যে ১০ থেকে ৯০ ভাগ টেন্ডার ঠিকাদার অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত হয়।’
পরিসংখ্যানের তথ্য উল্লেখ করে এই প্রকৌশলী বলেন, ‘পিএমপি বড় খাতে ২০২১-২২ অর্থবছরে ২৬০টি দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০২টি কাজ ২ জন ঠিকাদারের নামে অ্যাওয়ার্ড হয়েছে। একই অর্থবছরে উন্নয়ন প্রকল্পে ১২৪টি দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এরমধ্যে তিনজন ঠিকাদারই পেয়েছেন ৩৩টি কাজ।
এ বিষয়ে আবুল কালাম আজাদ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে বলেন, ‘পিএমপি ৬০ ভাগ কাজই ওটিএম (ওপেন টেন্ডারিং মেথড) পদ্ধতিতে, ৪০ ভাগ কাজ ওএসটিইএম (এক ধাপ দুই খাম টেন্ডার পদ্ধতি) দরপত্র আহ্বান করা হয়। চলমান ওটিএম পদ্ধতিতে নতুন নতুন ঠিকাদার সৃষ্টি হতে পারছে না।’ তিনি সারা দেশে ঝরে পড়া ঠিকাদারদের কর্মমুখী করতেও পরামর্শ দেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ছোট ছোট কাজগুলো পিপিআর অনুসরণ করে এলটিএম (লিমিটেড টেন্ডারিং মেথড) পদ্ধতি অনুসরণ করা যায়। এ ক্ষেত্রে সওজের তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টেন্ডার ইজিপি সিস্টেমে লটারির মাধ্যমে প্রয়োগ করা যায়। এভাবে দরপত্র আহ্বান করা হলে প্রচুরসংখ্যক ঠিকাদার তৈরির পাশাপাশি নির্মাণ শিল্পেও উত্তরণ ঘটবে।