টাঙ্গাইলের মধুপুরে মূলত ক্যালেন্ডার ও জলডুগি—এ দুই ধরনের আনারসের আবাদ হয়। জুন-জুলাই মাসে এগুলো বাজারজাত করা হয়। তবে রমজান সামনে রেখে মার্চ মাসেই বাজারে মিলছে জলডুগি আনারস।
চাষিদের একটি সূত্র জানায়, অতি মুনাফালোভী কৃষক ও ব্যবসায়ীরা মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করে অসময়ে এ জাতের আনারসকে পাকিয়ে বাজারজাত করছেন। এতে ভিটামিন ও খনিজ লবণসমৃদ্ধ এই ফলকে ‘বিষে’ পরিণত করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা আনারস খেলে অ্যালার্জি, চর্মরোগ থেকে শুরু করে ক্যানসারেও আক্রান্ত হতে পারে মানুষ।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে মধুপুরে ৬ হাজার ৮৪০ হেক্টর জমিতে আনারস আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ৩২৪ হেক্টরে জলডুগি এবং ৬ হাজার ৫১০ হেক্টরে ক্যালেন্ডার প্রজাতির আনারস আবাদ হয়েছে। এ ছাড়া পরীক্ষামূলকভাবে এমডি-টু জাতের আনারস আবাদ হয়েছে ৬ হেক্টরে। প্রাকৃতিকভাবে আনারস গুটি ধরা থেকে পাকা পর্যন্ত ছয় থেকে সাত মাস সময় লাগে। জলডুগি আনারস চারা রোপণ থেকে পাকা পর্যন্ত সময় লাগে ১২ মাস। আনারস জুন-জুলাই মাসে বাজারে আসার কথা থাকলেও মার্চেই বিক্রি শুরু হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মুনাফালোভী কৃষক ও অসাধু ব্যবসায়ীরা মিলে আনারসের চারায় গুটি ধরা, বড় করা ও পাকানোর কাজটি করছেন রাসায়নিক দিয়ে। ৪৫ পাতা হওয়ার পর আনারসের চারায় গ্রোথ হরমোন ব্যবহার করা যায়। কিন্তু কিছু চাষি ১২-১৫ পাতা হওয়ার পরই তা ব্যবহার করছেন। অপর দিকে ১৬ লিটার পানিতে ১৬ মিলিগ্রাম রাসায়নিক মিশিয়ে চারায় স্প্রে করার কথা কৃষি বিভাগ জানালেও কৃষকেরা ১৬ লিটারে দুই থেকে তিন শ মিলিগ্রাম ব্যবহার করছেন।
মধুপুরের ইদিলপুর, কুড়িবাড়ি, হাগুড়াকুড়ি, শোলাকুড়ি, ঘুঘুর বাজার, গায়রা গ্রামে ঘুরে বিভিন্ন বাগানেই দেখা যায় শ্রমিকেরা আনারসে রাসায়নিক ছিটাচ্ছেন। কৃষক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দ্রুত পাকানোর জন্য শুধু ইথোপেন রাসায়নিক স্প্রে করা হচ্ছে খেতে।
ইদিলপুরের সুকুমার বলেন, ‘আনারসের চারা বড় অইলে গাছের মাথায় গর্ভবতী (রাসায়নিক) দিলে কয়দিন পরেই সব গাছে গুটি ধরে। যে গাছে গুটি ধরে না সেই গাছে আবার গর্ভবতী দিলেই গুটি বাইর অয়। তার বাদে ১৫ /১৬ দিন পরপর দুইবার-তিনবার হরমোন দেই। আনারস বড় অয়। পাকানির ওষুধ দিলে ঝাত কইরা একবারে পাকে। এক মুহি থিকা কাটি আর বেচি।’
কুড়িবাড়ি এলাকায় কর্মরত শ্রমিক হায়দার আলী বলেন, ‘১৬ লিটার পানির কনটেইনারে দুই-তিন বোতল রাসায়নিক মিশাইয়া আনারসে স্প্রে করতাছি। ৭ দিনের মধ্যেই দারুণ কালার অইয়া পাইকা যাব। কয়দিন আগে যে আনারসে ওষুধ দিছি হেগনা (ওইগুলো) খেতেই বেচা অইতাছে।’
ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘৯০ লাখ টাকা দিয়ে ৩ লাখ ৭০ হাজার আনারস কিনেছি। সেই আনারসগুলো বাজারজাত শুরু করেছি। ঢাকা, চাটমোহর, উত্তরবঙ্গসহ বিভিন্ন জেলায় আনারস বিক্রি হচ্ছে। জলডুগি প্রতিটি আনারস খেতেই বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকা দরে। রোজা শুরু অইলে আনারসের টান থাকব বেশি। তখন আনারস খেতেই বিক্রি হবে ৩০-৩৫ টাকা দরে।’
কৃষি অফিস সূত্র জানায়, বর্তমানে মধুপুরে ২৬টি পাইকারি ও ১৬২টি খুচরা রাসায়নিক বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান আছে। দেশি, বিদেশি ও স্থানীয় ৭০টি কোম্পানির রাসায়নিক উপজেলায় বিক্রি হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা পেস্টিসাইড অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা জানান, চলতি মৌসুমে মধুপুরে সব কোম্পানি মিলিয়ে ৭৫ কোটি টাকার রাসায়নিক বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক কৃষিবিজ্ঞানী ড. আবু হাদী নূর আলী খান বলেন, ‘আনারসে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ লবণ থাকে। এতে বিভিন্ন নামের রাসায়নিক ব্যবহার হচ্ছে। হরমোন বা ইথোপেন মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এগুলো ভারত-চীন থেকে আসে। বাংলাদেশে যখন এই রাসায়নিক ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয় তখন আমরা আপত্তি জানিয়েছিলাম অনুমোদন না দেওয়ার জন্য। ক্ষতিকর এই রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে অ্যালার্জিসহ নানা চর্মরোগ, বদহজম, গ্যাস্ট্রিক, ক্যানসার হয়ে থাকে।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন রাসেল বলেন, ‘অনুমোদিত রাসায়নিক প্রতি লিটারে এক মিলি ব্যবহারের পরামর্শ কৃষককে দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁরা তা মানেন না। তাঁরা কোম্পানির লোকের পরামর্শে খেতে রাসায়নিক প্রয়োগ করেন। আনারসে রাসায়নিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের সবার সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।’