১১ মে ২০২৪, শনিবার, ০৫:০০:৩১ অপরাহ্ন
বড় দুই দলই কি তৃণমূলে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে?
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৮-০৪-২০২৪
বড় দুই দলই কি তৃণমূলে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে?

দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ওপর কি নিয়ন্ত্রণ, কর্তৃত্ব বা প্রভাব হারাচ্ছে? চলমান উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না আওয়ামী লীগ। প্রথম ধাপের নির্বাচনের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষদিন বুধবার পর্যন্ত দলের কয়েক দফা সতর্কতা, নির্দেশনা এবং দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে মন্ত্রী-এমপির ৫০ জনের বেশি স্বজন ভোটে আছেন।


গত ২০ এপ্রিল দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নেতাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘উপজেলা নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপির স্বজনদের সরে দাঁড়াতে হবে।’ এরপর তিনি বলেছিলেন, ‘শৃঙ্খলাজনিত কারণেই জাতীয় নির্বাচনেও অনেকে মন্ত্রী-এমপি হতে পারেনি, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে দল সময়মতো সিদ্ধান্ত নেবে।’ তারপর তিনি বলেন, ‘ভোটের আগের দিন পর্যন্ত নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সুযোগ রয়েছে।’ অর্থাৎ দলটি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাবে। কিন্তু এটি স্পষ্ট, এ চেষ্টাও নিষ্ফল হবে। দলটির কয়েকজন নেতা বৃহস্পতিবার আরও ছাড় দিয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘স্বজন হলেও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরা ছাড় পাবেন। তবে ৩০ এপ্রিল দলের নির্বাহী কমিটির সভা থেকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত ঘোষণা আসবে।


অপরদিকে, বিএনপি গত ১৬ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে উপজেলা নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলেও দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিএনপির কমপক্ষে ২০ নেতাকর্মী প্রার্থী হয়েছেন। দলটি হয়তো তাদের বহিষ্কার করবে। অবশ্য, এ প্রার্থীদের অনেকেই দলের কোনো পদে নেই। আবার কেউ কেউ আগেই বহিষ্কৃত। এ প্রার্থীদের অনেকেই মনে করেন, এটি ‘দলীয় নির্বাচন নয়’। আবার কেউ কেউ বলছেন, ‘জনগণ তাদের নির্বাচনে চাচ্ছে।’


এদিকে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বুধবার বলেছেন, ‘মন্ত্রী-এমপির নিকটাত্মীয়দের উপজেলা নির্বাচন থেকে সরে যেতে যে নির্দেশনা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দিয়েছে, তা আইনের মধ্যে পড়ে না। যিনি ভোটার হয়েছেন, এ রকম প্রত্যেকেরই নির্বাচন করার অধিকার আছে।’


আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ও মন্ত্রী উত্তরাধিকার সূত্রে যেমন কারও পিতা বা নিকটাত্মীয় দলের বড় নেতা বা মন্ত্রী-এমপি ছিলেন, সেই সূত্রে তারা রাজনীতিবিদ; বর্তমান মন্ত্রিসভায়ও বেশ কয়েকজন এমন সদস্য আছেন। বিএনপিতেও একই রকম। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজনীতি এখন পরোক্ষভাবে ‘ডাইনেস্টি বা রাজতন্ত্রের কৌলীন্য’ প্রথার পথে হাঁটছে। রাজনৈতিক দলগুলো যোগ্যতা অনুযায়ী সবার জন্য রাজনীতিতে সমান সুযোগের পথ সৃষ্টি করলেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অটুট থাকবে।


বিরোধী দলগুলো পরপর তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ সব ভোট বর্জন করায় নির্বাচনি ফলাফলে শুধু আওয়ামী লীগ ও তার স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরই জয়ধ্বনি। এবারের উপজেলা নির্বাচনেও অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের সংখ্যা নেই বললেই চলে। সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মাত্র তিনটি উপজেলায় প্রার্থীর খবর পাওয়া গেছে। তাহলে প্রথম দফার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আছে শুধুই আওয়ামী লীগ প্রার্থী, তাও আবার প্রতীকবিহীন। অর্থাৎ নিঃসন্দেহে বলা যায়, সব উপজেলা প্রশাসনই চলে যাচ্ছে সরকারি দলের দখলে!


বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করায় নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দেখাতে আওয়ামী লীগের মধ্য থেকে ডামি, স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহী প্রার্থী গ্রহণ করায় তৃণমূলে দলকে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত করেছে। মূলত এ একপক্ষীয় জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সরকারি দলের মধ্যে এক আপসহীন দলাদলি ও সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।


সরকারি দলের কেন্দ্র থেকে সমন্বিত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তৃণমূলের গৃহদাহ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। চলমান উপজেলা নির্বাচনে দলের তৃণমূলের প্রতিটি গ্রুপই তাদের এলাকায় এবং দলের মধ্যে প্রভাব-প্রতিপত্তি বজায় রাখতে দলের মনোনীত প্রার্থী যিনিই হতেন, তার বিরুদ্ধেই এক বা একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী দিতেন। সংঘাত-সহিংসতাও অনিবার্য হয়ে উঠত। তাই কোনোভাবেই কেন্দ্রের পক্ষে উপজেলা নির্বাচনে একক প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব ছিল না।


এহেন পরিস্থিতিতে দলাদলি ও সংঘাত-সহিংসতা এড়াতে আওয়ামী লীগ নয় বছর পর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতীক ব্যবহার থেকে পিছু হটে। অর্থাৎ স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে উন্নয়নের ভিত্তিমূল বিবেচনা না করে, সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থেই সরকারি দল প্রতীকবিহীন নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়।


সরকারি দল বলেছিল, ‘স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় দলীয় প্রতীক যুক্ত করার লক্ষ্য ছিল সব পর্যায়ে দলীয় জনপ্রতিনিধির ব্যবস্থা চালু করা। একেবারে দলীয় প্রতীক তুলে দিতে হলে আইনের সংশোধন করতে হবে। কিন্তু আইন সংশোধনের ইচ্ছা আপাতত আওয়ামী লীগের নেই; বরং বিদ্যমান উপজেলা আইন বহাল রেখেই দলীয় সিদ্ধান্তে প্রার্থী মনোনয়ন না দেওয়া। অর্থাৎ দলের সবার জন্য নির্বাচন উন্মুক্ত রাখা।’


আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার পর দলের অন্য কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে বা অন্য কারও পক্ষে ভোট করলে তাকে দল থেকে সরাসরি বহিষ্কার করা হবে। সে অনুযায়ী, ২০১৫ সালের পর সব ধরনের নির্বাচনে দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া নেতাদের বহিষ্কার করা হয়েছিল। অবশ্য, দলটির তৃণমূল নেতৃত্ব সংকটে পড়তে পারে, এ বিবেচনা থেকে পরে বহিষ্কারাদেশগুলো প্রত্যাহার করা হয়েছে।


উল্লেখ্য, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকার ১৯৮২-১৯৮৩ সালে ৪৬০টি থানাকে উন্নীত করে উপজেলা পদ্ধতি চালু করে। আইনে বিধান ছিল, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে উপজেলা পরিষদ গঠন হবে। তবে এ নির্বাচন সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে, যাতে স্থানীয় রাজনীতিকদের বাইরেও সমাজসেবকসহ যে কোনো পেশার মানুষ এ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন।


স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে উন্নয়ন কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু করতে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনকে সরাসরি দলীয় রাজনীতির বাইরে রাখা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, রাজনৈতিক দলগুলো প্রচ্ছন্নভাবে তাদের দল থেকে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে যার যার প্রার্থীকে বিজয়ী করতে নির্বাচনের কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়েছে।


এ অজুহাতে আওয়ামী লীগ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সহজ পথ বিবেচনা করে ২০১৫ সালে উপজেলা আইন সংশোধন করে দলীয় প্রতীকে নির্বাচনিব্যবস্থা চালু করে। দেশের অধিকাংশ স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ এ দলীয়করণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। সরকারের অনড় মনোভাবের কারণে অগত্যা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েতব্যবস্থার আদলে একটি ‘গ্রামীণ উন্নয়নের জন্য স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় সরকারব্যবস্থার’ পক্ষে মত দেন। অধিকাংশ বিরোধী দলও শুরু থেকেই এ সংশোধনীর বিরোধিতা করেছে।


কিন্তু সরকার আইনটি সংশধোন করে উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের শুধু চেয়ারম্যান এবং পৌরসভার মেয়র পদের নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের প্রতীক ব্যবহারের ব্যবস্থা চালু করে। উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হন স্থানীয় এমপি। এর মধ্য দিয়ে তৃণমূলের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সরাসরি রাজনৈতিক দলের অধীনে চলে যায়।


দেশে উপজেলার সংখ্যা ৪৯২। উপজেলা পরিষদ নির্বাচন চার পর্বে অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম পর্বে ১৫০ উপজেলায় ভোটগ্রহণ ৮ মে, দ্বিতীয় পর্বে ১৬১ উপজেলায় ২১ মে, তৃতীয় পর্বে ১২২ উপজেলায় ২৯ মে এবং শেষ পর্বের তফসিল এখনো ঘোষণা হয়নি। সর্বশেষ ২০১৯ সালে পাঁচ ধাপে দলীয় প্রতীকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি ও সমমনা বিরোধী দলগুলো প্রথমবার দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচন বর্জন করে।


শেয়ার করুন