গত ৫ বছরে ব্যবসায় খরচ বেড়েছে গড়ে প্রায় ৫০ শতাংশ, ৭ মাসে পণ্যের দরপতন হয়েছে ৬-৮ শতাংশ এবং অর্ডার কমে যাচ্ছে-এ পরিসংখ্যান বলে দেয় তৈরি পোশাকশিল্প কতটা নাজুক পরিস্থিতিতে আছে।
সংকট উত্তরণ এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাজেটে কার্যকর পদক্ষেপ রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত পূরণে শিল্পের কর অব্যাহতি কমিয়ে আনলে এবং জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি করলে তা সংকটকে আরও ঘনীভূত করতে পারে।
যুগান্তরকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি এসএম মান্নান কচি।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার-সাদ্দাম হোসেন ইমরান
যুগান্তর : রপ্তানি খাতের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে বাজেটে কী ধরনের পদক্ষেপ প্রত্যাশা করেন?
এসএম মান্নান : বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজারে যখন তৈরি পোশাকের চাহিদা ক্রমাগতভাবে কমছে। ৭ মাসে পণ্যের দরপতন হয়েছে ৬-৮ শতাংশ।
পক্ষান্তরে শ্রমিকদের মজুরিসহ সব খরচ ঊর্ধ্বমুখী। এ অবস্থায় আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিনিয়োগ ও শিল্পের জন্য সহায়ক কিছু নীতি সমর্থন ও দিকনির্দেশনা থাকা উচিত। বিশেষত উৎপাদনশীল ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতে করের চাপ কমানো আমাদের প্রধান প্রত্যাশা। রপ্তানির বিপরীতে উৎসে কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে পূর্বের মতো দশমিক ৫০ শতাংশ করে আগামী ৫ বছর পর্যন্ত কার্যকর করার প্রস্তাবটি সরকার সুবিবেচনায় নেবে বলে আশা করি।
সেই সঙ্গে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি শুল্ক কমানো, এক্সপোর্ট রিটেনশন কোটার (ইআরকিউ) ওপর ট্যাক্স প্রত্যাহার, নগদ সহায়তার ওপর ট্যাক্স প্রত্যাহার এবং শিল্পকে নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব করতে প্রয়োজনীয় আমদানির ওপর শুল্ক ও কর প্রত্যাহারের বিষয়ে সরকারের নজর দেওয়া উচিত।
পাশাপাশি ব্যবসায় খরচ কমাতে বিদ্যুৎ-গ্যাসের মূল্য যাতে না বাড়ে, এর ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংক ঋণের সুদ সিঙ্গেল ডিজিটের মধ্যে রাখার বিষয়ে কিছু দিকনির্দেশনা থাকবে বলে আশা করি।
যুগান্তর : বাজেটে বিনিয়োগ-কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে কী কী পদক্ষেপ থাকা উচিত?
এসএম মান্নান : বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দাভাব বিরাজ করায় আমাদের অর্থনীতিতেও একটি চাপ রয়েছে। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। একমাত্র শিল্প খাতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান এ চাপ মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এ মুহূর্তে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
বিশেষ করে ব্যবসায় খরচ বৃদ্ধি ও জটিলতা ব্যবসা-বিনিয়োগ পরিবেশের জন্য বড় একটি অন্তরায় বলে মনে করি। বিশেষ করে কাস্টমস, শুল্ক-কর-ভ্যাট ও বন্দরসংক্রান্ত কিছু জটিলতা রয়েছে। যে কারণে আমাদের সময় ও অপ্রয়োজনীয় খরচ বাড়ছে। এ সেবা খাতগুলোকে যদি আরও ব্যবসাবান্ধব ও গতিশীল করা যায়, তাহলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন উৎসাহ ও উদ্যম ফিরে আসবে। আমাদের সময় ও খরচ সাশ্রয় হবে এবং প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়বে।
যুগান্তর : তৈরি পোশাক খাত বর্তমানে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে?
এসএম মান্নান : শিল্পায়নের জন্য বিদ্যুৎ ও গ্যাস অত্যন্ত অপরিহার্য। এ বিষয়গুলো বিনিয়োগের জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর। যদিও বিগত দশকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে আমাদের অভাবনীয় সাফল্য এসেছে। তদুপরি বেশকিছু সমস্যা রয়ে গেছে। গ্যাসের অনিয়মিত চাপ আমাদের শিল্পের জন্য বড় ভোগান্তির কারণ।
তৈরি পোশাক খাতকে পণ্যের আন্তর্জাতিক কোয়ালিটি মেইনটেইন করতে হয়, যা গ্যাসের অনিয়মিত চাপের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া ডিজেল দিয়ে জেনারেটর চালাতে খরচ দ্বিগুণের বেশি বাড়ে, এতে উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হয়। অপরদিকে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম নিয়মিতভাবে বেড়েই চলছে। ফলে উদ্যোক্তারা তাদের বিনিয়োগ পরিকল্পনা অনুযায়ী টেকসই করতে পারছেন না।
আরেকটি প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো ব্যাংকের উচ্চ সুদ। বিগত প্রায় এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংক সুদ ১৩-১৫ শতাংশে পৌঁছেছে। এত উচ্চ সুদ দিয়ে ব্যবসার প্রতিযোগী সক্ষমতা টিকিয়ে রাখা খুব কঠিন। কারণ, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে হয়। প্রতিযোগিতায় ঝরে পড়াদের সুবিধার্থে বাজেটে সরকার একটি নিরাপদ এক্সিট পলিসির রূপরেখা দিতে পারে।
যুগান্তর: আইএমএফ ঋণের শর্ত হিসাবে কর অব্যাহতি কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে। এতে দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে কি?
এসএম মান্নান : আইএমএফ-এর পরামর্শ রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য। তবে রাজস্ব আহরণে সব সময় প্রত্যক্ষ করের ওপর নির্ভর করলে চলবে না, বরং এতে উৎপাদনশীল খাত নিরুৎসাহিত হবে। পক্ষান্তরে এটি সরকারের সার্বিক রাজস্ব আয়েও বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।
অতএব প্রত্যক্ষ করের পাশাপাশি উৎপাদনশীল খাত টিকিয়ে রাখার বিষয়টিতে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। আর করের হার না বাড়িয়ে করের পরিধি বাড়াতে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত বলে মনে করি। কর ব্যবস্থাপনা ও পদ্ধতি এমন হওয়া উচিত যেন সরকারের রাজস্ব আসে, সেই সঙ্গে উৎপাদনশীল খাতের ওপর করের বোঝা না বাড়ে।
কিন্তু আইএমএফ-এর শর্ত অনুযায়ী একপেশেভাবে কর বাড়ানো হলে শিল্পে বিরূপ প্রভাব পড়বে। কারণ, আমরা ইতোমধ্যে একটি সংকটময় মুহূর্তে আছি। ৫ বছরে ব্যবসায় খরচ বেড়ে গড়ে প্রায় ৫০ শতাংশ, চলতি বছর মজুরি বেড়েছে প্রায় ৫৬ শতাংশ এবং বিদ্যুৎ গ্যাস ও পরিবহণ খরচ বেড়েছে।
অন্যদিকে আমাদের পণ্যের দরপতন হয়েছে ও হচ্ছে। ফলে শিল্প একটি চাপের মধ্যে আছে, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলো অস্তিত্ব সংকটে আছে। এখন প্রয়োজন কর কমিয়ে আনা, যেন কর্মসংস্থান টিকে থাকে।
যুগান্তর : জ্বালানি খাতের ভর্তুকি কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ। এতে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা আছে। শিল্পে এর কেমন প্রভাব পড়বে?
এসএম মান্নান : যে কোনো পদক্ষেপের কারণে যদি ব্যবসায় খরচ আরও বাড়ে, তবে সেটি আমাদের শিল্পের জন্য হবে একটি অশনিসংকেত। আগেও বলেছি, আমাদের খরচ অসহনীয়ভাবে বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের চাহিদা কমে আসছে, তাই দরপতন হচ্ছে।
বিগত ৫ বছরে গ্যাসের দাম বেড়েছে ২৮৬.৫ শতাংশ, আর বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৩৩.৫০ শতাংশ। কিন্তু আমরা গ্যাসের পর্যাপ্ত চাপ পাচ্ছি না, ঢাকার বাইরের কারখানাগুলো ডিজেল-জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করছে।
অতএব, আমরা ইতোমধ্যে একটি সংকটের মধ্যে আছি। এর ওপর কোনো পদক্ষেপ যদি ব্যবসার খরচ আরও বাড়িয়ে দেয়, সেটি অর্থনীতির সার্বিক মঙ্গলের জন্য সময়োপযোগী হবে বলে মনে করছি না। গ্যাস এবং বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি শুধু যে পোশাকশিল্পের ওপরই প্রভাব রাখবে, তা নয়। বরং এটি দেশের জনগণের ওপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। কারণ, এর কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী ও পরিষেবাগুলোর মূল্য বেড়ে যাবে। এ পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতির চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে, যা কারও কাম্য নয়।
যুগান্তর : ঋণের সুদহার লাগামহীনভাবে বাড়ছে। এটি সমাধানের উপায় কী?
এসএম মান্নান : ব্যাংকিং খাতে আরও সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি আনা প্রয়োজন। আমানতকারীদের সুরক্ষা দিতে হবে, একই সঙ্গে বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করতে হবে। ব্যবস্থাপনার ঘাটতিতে ব্যাংকিং খাতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব যদি গ্রাহক পর্যায়ে পড়ে, সেটি আমাদের অর্থিনীতির জন্য সার্বিকভাবে মঙ্গলজনক হবে না।
বিশেষ করে এর প্রভাব যদি সুদের হারের ওপর পড়ে, সেটি আমাদের বিনিয়োগ ও ব্যবসাকে বাধাগ্রস্ত করবে। ইতোমধ্যে সুদের হার ১৩-১৫ শতাংশে পৌঁছে গেছে, যা গত বছর সিঙ্গেল ডিজিটে ছিল। ব্যাংক একীভূতকরণ করার মতো বড় পদক্ষেপগুলো নেওয়ার ক্ষেত্রে দেখতে হবে এতে গ্রাহকরা সুরক্ষা পাচ্ছেন নাকি এটি নিছক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে এক্সিট দেওয়ার একটি ব্যবস্থা, যার ভার সবাইকে বহন করতে হচ্ছে।
যুগান্তর : পণ্য খালাসে কাস্টমসে হয়রানি, বন্ড অডিট এবং ভ্যাটের জটিলতা রপ্তানিমুখী শিল্পের বাড়ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?
এসএম মান্নান : এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা। এর জন্য একদিকে যেমন প্রয়োজন স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করা; অন্যদিকে প্রয়োজন প্রতিটি পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো। কাস্টমস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন যতটা সম্ভব ডিজিটাল এবং ডাইনামিক করা গেলে আমরা প্রতিনিয়ত যে নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হয়, সেটি থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি।
যেমন: এইচএস কোড সংক্রান্ত সমস্যা দূর করতে হলে একটি ডাইনামিক ব্যবস্থাপনা বা পদ্ধতি প্রয়োজন। যার মাধ্যমে সর্বজন গৃহীত পদ্ধতিতে এইচএস কোড তালিকা হালনাগাদ করা যেতে পারে। আমাদের এরকম ইনোভেটিভ সলিউশন বের করতে হবে যাতে আমরা কার্যকরভাবে সমস্যা সমাধান করতে পারি।
কাস্টমস, বন্ড এবং ভ্যাটসংশ্লিষ্ট মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা, বিশেষ করে রাজস্ব কর্মকর্তাদের জবাবদিহি নিশ্চিতের বিষয়ে আরও উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে শিল্পের আমদানিকৃত মালামাল খালাসে এবং রপ্তানি পর্যায়ে অহেতুক বিলম্ব ও জটিলতা যেন না হয়, সে বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।
বন্ড অডিটের ক্ষেত্রে যথাসম্ভব স্বল্পসংখ্যক প্রয়োজনীয় তথ্যের ভিত্তিতে অনলাইনের মাধ্যমে অডিট কার্যক্রম সম্পাদন করা যেতে পারে। আমরা চাই সবক্ষেত্রে নিয়ম প্রতিষ্ঠা হোক, সেটি আমাদের উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তবে নিয়ম হওয়া উচিত শিল্প ও অর্থনীতির স্বার্থে, নিয়মের দোহাই দিয়ে জটিলতা তৈরি হলে দেশ ও অর্থনীতি উপকৃত হবে না।
যুগান্তর : এনবিআর-এর সক্ষমতা বাড়াতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
এসএম মান্নান : এনবিআর-এর সক্ষমতা বাড়াতে সবার আগে প্রয়োজন সদিচ্ছা। সক্ষমতা বাড়াতে অটোমেশন ও ডিজিটালাইজেশন অত্যন্ত সহায়ক হতে পারে। পাশাপাশি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ব্যবস্থা আনার জন্য কার্যকরী উদ্যোগ প্রয়োজন।
আমাদের একটি ডাইনামিক কাস্টমস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ব্যবস্থা প্রয়োজন, যেন কাঁচামাল বা মেশিনারি আমদানির নতুন নতুন সংযোজনগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপলোড হতে পারে। আর এসব বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল বেস্ট প্র্যাকটিসগুলো আমরা দেখতে পারি এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অনুসরণ করতে পারি।
মনে রাখা জরুরি, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পোশাকশিল্পকে দেশের বাইরে যথেষ্ট প্রতিযোগিতায় পড়তে হবে। তাই শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধির স্বার্থে আমাদের পলিসি এবং প্রশাসনিক সংস্কার প্রয়োজন। কারণ, রপ্তানির ওপর প্রচলিত সহায়তা শেষ হয়ে গেলে আমাদের নীতি, প্রশাসনিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে প্রতিযোগী সক্ষমতাটি ধরে রাখতে হবে।