২২ নভেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ০১:৪৭:২০ পূর্বাহ্ন
নতুন করে বেড়েছে পেঁয়াজ, ডিম, মুরগি, গরুর মাংস, সবজিসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম।
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৩-০৫-২০২৪
নতুন করে বেড়েছে পেঁয়াজ, ডিম, মুরগি, গরুর মাংস, সবজিসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম।

বছরের এই সময় আলু সাধারণত সস্তা থাকে। সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ২০২১, ২০২২ ও ২০২৩ সালের ৯ মে তারিখে বাজারদরের তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, আলুর কেজি সর্বনিম্ন ২২ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ টাকার মধ্যে ছিল। এবার সেই আলুর দাম ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। গত বছরের তুলনায় মূল্যবৃদ্ধি ৫৭ শতাংশ।


বাংলাদেশ আলু আমদানি করে না। সরকারি হিসাবে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি। প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ১৩ টাকা ৯০ পয়সা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মতে, বাজারে যৌক্তিক মূল্য হওয়া উচিত ২৮ টাকা ৫৫ পয়সা। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। মূল্য নিয়ন্ত্রণের বদলে সরকার আলু রপ্তানিকে উৎসাহিত করছে। নগদ ১৫ শতাংশ ভর্তুকিও দেওয়া হচ্ছে।


আলুর মতো বাজারে নতুন করে পেঁয়াজ, রসুন, ডিম, মুরগি, গরুর মাংস, সবজি, মসলাসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে। আগে থেকেই উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, আটাসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্য।


উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে নতুন করে মূল্যবৃদ্ধি নিম্ন আয়ের মানুষের সংকট বাড়িয়েছে। যদিও গত ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের পর গঠিত নতুন সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অগ্রাধিকারের কথা বলেছিল। নতুন মন্ত্রিসভা আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আশাবাদের কথা শুনিয়েছিল। এরপর রোজায় ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুরে কিছু শুল্কছাড় দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য রোজার পরই তেলের করছাড় তুলে নেওয়া হয়। ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেন লিটারে ৪ টাকা।


এদিকে নতুন বছরে বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। গত মার্চে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম গড়ে ৮ শতাংশ বাড়ানো হয়। জ্বালানি তেল ডিজেলের দাম লিটারে ৩ টাকা কমিয়ে পরে ১ টাকা বাড়ানো হয়। যদিও এতে পরিবহন ভাড়া কমেনি। ব্যাংকঋণের সুদের হার বাড়ায় ডলারের ওপর চাপ কমেছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদেরা। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্য নির্ধারণের নতুন পদ্ধতি (ক্রলিং পেগ) চালু করার কারণে ডলারের দাম এক লাফে ৭ টাকা বেড়ে গেছে, যা মূল্যস্ফীতি আরও উসকে দেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।


অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে সময়মতো ও সুনির্দিষ্ট পণ্যভিত্তিক ব্যবস্থা নিতে হবে। শুধু বৈঠক করা, দাম নির্ধারণ করে দেওয়া ও মুখের কথা দিয়ে বাজারকে থামানো যাবে না। 


আলুর দাম নিয়ে সে কথাই বলেন হিমাগার মালিক সমিতির সভাপতি এবং বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সাবেক সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মার্চে নতুন মৌসুমের আলু ওঠার পর হু হু করে দাম বেড়ে যায়। সেই দামে আলু হিমাগারে রেখে এখন কম দামে বিক্রি করা সম্ভব নয়। তখনই বাজারে হস্তক্ষেপ করা দরকার ছিল। তিনি বলেন, গত এপ্রিলের শেষ দিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হয়েছে। সেখানে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে গত মৌসুমে ১ কোটি ৪ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। হিমাগারমালিকদের হিসাবে, এটা ৭০ লাখ টনের বেশি নয়। দেশে আলু দরকার ৯০ লাখ টন। ফলে বিপুল ঘাটতি আছে। এ কারণেই দাম বাড়ছে।


মোস্তফা আজাদ চৌধুরী আরও বলেন, চাহিদা ও উৎপাদনের হিসাবে ঘাপলা আছে। এই পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়।


নিত্যপণ্যের দাম: তখন, এখন

বাজারে মিষ্টিকুমড়া কমদামি সবজিগুলোর একটি। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বাজারদরের তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২১ ও ২০২২ সালের ৯ মে ঢাকার বাজারে মিষ্টিকুমড়া সর্বনিম্ন ২০ টাকা কেজি ছিল। এখন তা ৩০ টাকা। মানে হলো, সর্বনিম্ন মূল্য ৫০ শতাংশ বেড়ে গেছে।


বাজারে জনপ্রিয় সবজি বেগুনের দামের চিত্রটি আরও উদ্বেগজনক। ২০২১ সালে যে বেগুন ৪০ থেকে ৫০ টাকা ছিল, তা বাড়তে বাড়তে এবার (গতকাল রোববার) ৮০ থেকে ১০০ টাকা হয়েছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, বিগত এক মাসে বেগুনের দাম বেড়েছে ১৫৭ শতাংশ।


সার্বিকভাবে সবজির দাম চড়া। ঢাকার বাজার ঘুরে গত কয়েক দিনে দেখা গেছে, বেশির ভাগ সবজির কেজি ৬০ থেকে ৮০ টাকা।


মাছের দাম ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধির একটি উদাহরণ হলো পাঙাশ মাছ। ২০২১ সালের ৯ মে ঢাকার বাজারে পাঙাশ মাছের কেজি ছিল ১২০ থেকে ১৪০ টাকা। তা এখন ১৮০ থেকে ২৫০ টাকা। বেড়েছে রুই, কাতলা ও ইলিশের দামও (অন্য মাছের দামের হিসাব রাখে না কৃষি বিপণন অধিদপ্তর)।


বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য পর্যালোচনা ও নিজেদের উদ্যোগে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন গত বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বলেন, দেশে গরিব মানুষের ক্ষেত্রে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখন ১৫ শতাংশে পৌঁছেছে। মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে মাছের দাম। এরপর রয়েছে পোলট্রি পণ্য—মুরগির মাংস ও ডিম।


বাজারে এখন ফার্মের সোনালি জাতের মুরগির কেজি ৩৮০ থেকে ৪০০ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলেন, এত দাম তাঁরা কখনো দেখেননি। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, এক মাসে দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ। বছর চারেক আগেও এই মুরগি সাধারণত ২২০ থেকে ২৪০ টাকা কেজি বিক্রি হতো। শীত শেষে দাম কিছুটা বাড়ত। যেমন ২০২১ সালের ৯ মে দাম ছিল ২৬০ থেকে ২৮০ টাকা কেজি।


গরুর মাংস দূরে থাক, অসচ্ছল মানুষের পক্ষে এখন ব্রয়লার মুরগি ও ডিম কেনাও কঠিন। এক হালি ডিম উঠেছে ৫০ টাকায়, যা সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে ওঠানামা করত। গরুর মাংসের কেজিপ্রতি দর ৭৫০–৮০০ টাকা।


অর্থনীতিবিদ, বাজার বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা বলেন, মূল্যবৃদ্ধির দুটি ধরন এখন বাজারে দেখা যায়। একটি হলো মূল্যস্তর বেড়ে যাওয়া, অন্যটি সাময়িক মূল্যবৃদ্ধি। মূল্যস্তর বেড়ে যাওয়ার উদাহরণ দিয়ে তাঁরা বলেন, ২০২২ সালে সয়াবিন তেলের টন দুই হাজার ডলারে উঠেছিল। বাংলাদেশে ১০০ টাকা থেকে বেড়ে দাম হয়েছিল ২০০ টাকা লিটার। এখন বিশ্ববাজারে সয়াবিন তেলের দাম ৯০০ ডলারের নিচে। তবে দেশে কমে অর্ধেক হয়নি। বাজারে দাম ১৬৭ টাকা লিটার।


স্থায়ী মূল্যবৃদ্ধির কারণ ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির চক্র। টানা মূল্যস্ফীতি হতে থাকলে কৃষক, ফড়িয়া, পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীকে সমপরিমাণ পণ্য বিক্রি করে আগের চেয়ে বেশি আয় করতে হয়। ফলে সবাই বাড়তি দাম নিতে শুরু করেন।


শেয়ার করুন