নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের মাংসের চাহিদা মেটে ব্রয়লার ও সোনালী মুরগি দিয়ে। এর মধ্যে অনেকেই আবার ব্রয়লার মুরগির মাংস খান না। তবে সোনালী মুরগির মাংস খান স্বাচ্ছন্দ্যে। তবে বাজার থেকে ক্রেতারা যে সোনালী মুরগি কিনে খাচ্ছেন। সেটি কি আদৌ সোনালী মুরগি, নাকি অন্য জাতের মুরগি?
জানা গেছে, দেখতে সোনালী মুরগি হলেও এটি আসলে সোনালী মুরগি নয়। বাজারে বিক্রি করা এ মুরগি সোনালীর চেয়ে বড় ও ওজনে বেশি। ক্রেতারা বলছেন, এর মাংসের স্বাদ নেই। কিছুটা ব্রয়লার মুরগির কাছাকাছি।
পোল্ট্রি খামার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে খুব কম সোনালী মুরগি পাওয়া যায়। সোনালীর চাহিদা বেশি। মাসে দুই থেকে তিনদিন কিছু বিক্রেতার কাছে সোনালী মুরগি পাওয়া যায়। পুরো মাসই সোনালীর নামে বিক্রেতারা ক্রেতাদের কাছে ভিন্ন জাতের মুরগি বিক্রি করছেন। শুধুমাত্রা বাজারে সোনালীর নামে আট জাতের মুরগি কেনা-বেচা হয়। এই আট জাতের মুরগিগুলো শুধু মাত্র বিক্রেতারাই চেনেন। ক্রেতাদের কাছে সব জাতই সোনালী নামে পরিচিত। মুরগিগুলো দেখতে সোনালীর মত হলেও তা সোনালী না। এই মুরগিগুলো হচ্ছে- ক্লারবার্ড, ক্লাসিক, কয়লার, সুপার বার্ড, সুপার হাই ব্রিড, হাই সুপার, ফিপিএফ-৩, হাইব্রিড সোনালী।
মুরগি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্রয়লার মুরগির মাংস দ্রুত বৃদ্ধি পায়। সেই তুলনায় সোনালী মুরগির মাংস কম বৃদ্ধি পায়। সোনালী আকারে ছোট। যদিও বা তাদের লালন-পালনের সময় অনেকটা একই। তবে ব্রয়লারের তুলনায় সোনালী মুরগিতে কিছুটা মুনাফা কম। আবার সোনালীর তুলনায় বেশি মুনাফা ক্লারবার্ড বা ক্লাসিক জাতের মুরগি পালনে। ব্রয়লার মুরগি সাধারণত দুই থেকে আড়াই কেজির উপরে হয়। সোনালী মুরগির নামে বাজারে চলা ক্লাসিক মুরগি ওজন হয় ৮০০ গ্রাম থেকে ১ কেজির কাছাকাছি। তবে সোনালী মুরগির ওজন ৪০০ গ্রাম থেকে ৬০০ গ্রাম হয়ে থাকে। সোনালী মুরগির সবচেয়ে বেশি চাহিদা ‘রোস্ট’ হিসেবে।
নগরীর বিনোদপুর, কাটাখালী, তালাইমারী, সাহেববাজার, খড়খড়ি বাজারের মুরগি ব্যবসায়ীরা জানান, দীর্ঘদিন থেকে সোনালী মুরগি পাওয়া যায় না। কোনো কোনো সময় পাওয়া যায়। তবে তুলনায় অনেক কম। সোনালী মুরগি আকার ও ওজনে কম হওয়ায় এর চাহিদা বেশি। যারা বেশি টাকায় দেশি মুরগি কিনতে পারেন না, আবার ব্রয়লার মুরগি খান নাÑ তারাই বেশি সোনালী মুরগি কিনে থাকেন। কিন্তু সোনালী মুরগির সরবরাহ না থাকায় ক্লাসিকসহ বিভিন্ন মুরগি তারা বিক্রি করে থাকেন। বাজারে ক্লাসিক মুরগি সোনালী নামে প্রচলিত রয়েছে।
নগরীর বিনোদপুর বাজারের মুরগি ব্যবসায়ী ওবাইদুর রহমান বলেন, প্রায় আট থেকে নয় মাস হলো সোনালী মুরগি পাইনি। সবার একই অবস্থা। কারও কাছে সোনালী মুরগি নেই। সবাই ক্লাসিক মুরগি বিক্রি করছে। সোনালী মুরগির নামে ক্লাসিক মুুরগি বিক্রি করছে সবাই। জয়পুরহাট সোনালী মুরগির উৎপাদন কেন্দ্র। সেখানেই সোনালী মুরগি নেই। এছাড়া আশপাশের খামারিরাও ক্লাসিক মুরগি পালন করে থাকেন। আমাদের কাছে সেই মুরগি তারা বিক্রি করে, তারপর আমরা ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করি।
সোনালী মুরগি ক্রেতা সঞ্জয় কুমার জানেন না সোনালী মুরগির নামে কি মুরগি কিনছেন। তবে তিনি দোকানে এসে বিক্রেতার কাছে সোনালী মুরগি চেয়েছেন। আর বিক্রেতা ক্লাসিক মুরগি দিয়েছেন। মুরগির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, এই মুরগিকে (ক্লাসিক) তিনি সোনালী হিসেবে চেনেন।
সঞ্জয় কুমার বলেন, আমরা ব্রয়লার মুরগি খাই না। তবে বাড়ির সবাই সোনালী মুরগি খায়। কিছুদিন থেকে লক্ষ্য করছি এই মুরগির ওজন এক কেজির কাছাকাছি। আর মাংস ব্রয়লার মুরগির মত। সোনালির মাংস দেশি মুরগির মত হাড়ের সাথে লেগে থাকে। কিন্তু এগুলো একটু ভিন্ন। সোনালি মুরগি রান্না করা মাংস ঠান্ডা হলেও তেমন গন্ধ লাগে না। কিন্তু ইদানিং এই সোনালীর মাংস রান্নার পরে ঠান্ডা অবস্থায় ঘ্রাণ লাগে ব্রয়লার মুরগির মতো। তেমন স্বাদও নেই। কেউ কেউ বলে এটা নাকি ক্লাসিক মুরগি, সোনালী না। অনেক মুরগি ব্যবসায়ী স্বীকার করে না। তারা বলে এটাই সোনালী মুরগি। আমরা চিনি না। না চিনেই খাচ্ছি।
পবা উপজেলার খড়খড়ি বাইপাস মোড়ে মুরগি বিক্রেতা এনামূল হক বলেন, মাসে দু’তিনদিন পাই সোনালী মুরগি। সারা মাস ক্লাসিক সোনালী নামে বিক্রি করি। তবে যারা চেনে তারা সোনালী মুরগি আছে কিনা জানতে চাই। আমরা বলি সোনালী নাই, ক্লাসিক মুরগি আছে। তখন অন্য দোকান ঘুরে এসে বাধ্য হয়ে ক্লাসিক মুরগি কেনে ক্রেতা। সোনালী মুরগির চাহিদা আছে। অনেকটাই দেশি মুরগির মাংসের মতো স্বাদ। তবে পুরোপুরি না। কিন্তু আমরা সোনালী মুরগি পাই না। খামারিরা সোনালী মুরগি চাষ করে না।
ক্রেতা জিয়ারুল ইসলাম বলেন, ব্রয়লার মুরগি খাই না। কিন্তু সোনালী মুরগি খাই। এখনকার সোনালী মুরগির ওজন এক কেজি করে। আগে সোনালী মুরগি কিনতাম ৫০০ গ্রাম থেকে ৬০০ গ্রামের। কিন্তু এখন এই সোনালী মুরগি পাওয়া যায় না। এখনকার সোনালী ব্রয়লার মুরগির সমান। মাংসে স্বাদ নেই। সোনালী মুরগির নামে আমরা কী খাচ্ছি কে জানে?
খামারি রাকিবুল ইসলাম বলেন, সোনালী মুরগির বাচ্চা তেমন পাওয়া যায় না। আর সোনালী মুরগি তেমন বৃদ্ধি পায় না। এ কারণে খামারিরা সোনালী মুরগি পালন করতে চান না। সোনালীর কয়েকটা হাইব্রিড জাত রয়েছে সে মুরগি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ওজনের দিক থেকেও বেশি। বেশি মুনফার জন্য আমরা এই মুরগি পালন করে থাকি।
জয়পুরহাটের শেফালী পোল্ট্রি অ্যান্ড হ্যাচারির ম্যানেজার মিজানুর রহমান বলেন, খাবারের দাম বেড়েছে। তাই সোনালী মুরগি পালনে মুনাফা হচ্ছে না খামারিদের। খামারিরা সোনালী ছাড়া অন্য হাইব্রিড জাতের মুরগি পালন করছেন। বাজারে সোনালী মুরগির নামে আটটি জাতের মুরগি চলে। যে মুরগি দেখতে সোনালী মুরগির মতো। কিন্তু ওজনের দিক থেকে ব্রয়ারের কাছাকাছি। এগুলো হলো ক্লারবার্ড, ক্লাসিক, কয়লার, সুপার বার্ড, সুপার হাইব্রিড, হাই সুপার, ফিপিএফ-৩, হাইব্রিড সোনালী।
তিনি আরও বলেন, সোনালী মুরগির চাষ কমে গেছে। খামারিদের মধ্যে ‘১ আনা’ সোনালী মুরগি চাষ করে। বাকি ‘১৫ আনা’ ক্লাসিকসহ অন্য হাইব্রিড জাতের মুরগি পালন করে। ৬০ থেকে ৬৫ দিনের একটি সোনালী মুরগির ওজন হবে ৬৫০ থেকে ৭০০ গ্রাম। একই সময়ে ক্লাসিকসহ অন্য হাইব্রিড মুরগির ওজন ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম বেশি হবে। এতে করে একই সময়ে একই খরচে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কম বেশি পাবে খামারিরা। খামারিরা শুধুমাত্র ওজনের কারণে টাকা বেশি পাবে। তবে ক্লাসিক বা হাইব্রিড মুরগির মাংস সোনালীর মতো স্বাদ নেই।
রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. জুলফিকার মো. আখতার হোসেন বলেন, প্রাইভেট কোম্পানিগুলো ক্লারবার্ড বা ক্লাসিক মুরগিগুলো উৎপাদন করছে। এতে সোনালী মুরগির চেয়ে তুলনামূলক মুনাফা বেশি। যেখানে সোনালী মুরগি দেড় মাসে ৬০০ গ্রাম থেকে ৭০০ গ্রাম হবে। সেখানে ক্লাসিক মুরগি ৮০০ গ্রাম থেকে সাড়ে ৮০০ গ্রাম হবে। তবে সোনালী মুরগি একেবারেই নেই তা কিন্তু নয়। সোনালী মুরগি চাষ হচ্ছে। তবে তুলনায় অনেক কম।
