০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ১১:১২:১৬ অপরাহ্ন
রাজধানীর ‘দাগি’ ভবন চেনাবে গুগল ম্যাপ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০২-০৬-২০২৪
রাজধানীর ‘দাগি’ ভবন চেনাবে গুগল ম্যাপ

রাজধানী ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো বারবার চিহ্নিত করা হলেও সেগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না সরকার। তবে এবার বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে গুগল ম্যাপে সেসব ভবনের ট্যাগ নোটিস সংযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর ফলে গুগল ম্যাপ ব্যবহার করে যে কেউ সহজেই ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর ব্যাপারে তথ্য জানতে পারবেন। সতর্কতামূলক এই উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।


 


সম্প্রতি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সভাকক্ষে নগর উন্নয়ন কমিটির সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রাজউককে। তাছাড়া চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে সরাসরি নোটিস টাঙিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। যেন ব্যবহারকারীরা নিজ দায়িত্বে ওইসব ভবন ব্যবহার করেন অথবা পরিহার করার কথা ভাবতে পারেন।


রাজউক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রক্ষা করতে নানাভাবে প্রভাবশালীরা চাপ প্রয়োগ করে থাকেন। অন্তত ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে মানুষকে চিনিয়ে দিতে পারলে, সবাই নিজ দায়িত্বে নিরাপদ থাকার চেষ্টা করতে পারবে। এমন চিন্তা থেকেই গুগল ম্যাপে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের ট্যাগ দেওয়ার উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছে। এর ফলে কেউ বাড়ি ভাড়া নিতে অথবা কোনো কাজে গেলে, সেই ভবন সম্পর্কে আগাম তথ্য জেনে নিতে পারবেন। 


বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি এবং নগর উন্নয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান মনে করেন, গুগল ম্যাপে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তথ্য দিলে সেটা ভবন ব্যবহারকারীদের জন্য সুবিধাজনক ব্যাপার হবে। অন্তত মানুষ নিজ থেকে সতর্ক হতে পারবে। কেউ বাড়ি ভাড়া নিতে গিয়ে যদি ঝুঁকিপূর্ণ সাইবোর্ড দেখেন, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন, ওই বাড়িটি আদৌ ভাড়া নেবেন কি নেবেন না। কেউ কোনো হোটেলে উঠতে যাওয়ার আগেও যদি গুগল ম্যাপ ব্যবহার করে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ কি না সেই তথ্য পেয়ে যান, তাহলে নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে। 


তিনি আরও বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মধ্যে যেগুলো ভেঙে ফেলার সুপারিশ করা হয়েছে সেগুলো অবশ্যই ভাঙতে হবে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় এটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। তাই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তথ্যগুলো যত দ্রুত ব্যবহারকারীদের কাছে দেওয়া যায় ততই ভালো। 


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটি গাইডলাইন প্রস্তুত করেছে রাজউক। তবে আরও যাচাই-বাছাই করে সেটি কমিটির আগামী সভায় উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ৪২টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে রাজউকের তত্ত্বাবধানে ‘ভবনসমূহ ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যবহারকারীরা নিজ দায়িত্বে ব্যবহার করবেন’ লেখা সাইনবোর্ড টাঙানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাছাড়া ভবনের সামনে প্রদর্শিত সাইনবোর্ডে অনুমোদিত নকশার বিশদ বিবরণ রাখা বাধ্যতামূলক করা, ভবনগুলো নিরাপদ করতে রাজউক বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে নিয়মিত সভার আয়োজন করবে, রাজউকের নেতৃত্বে আন্তঃসংস্থার প্রতিনিধিরা নিয়মিত ভবনগুলো পরিদর্শন করবে, পরিদর্শনের সময় বিআইপি, আইইবি ও আইএবি প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন। 


সে সময় রাজউকের মোবাইল কোর্ট বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অকুপেন্সি সার্টিফিকেট ব্যতীত ইউটিলিটি সেবা (গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও ট্রেড লাইসেন্স) না দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দেবে রাজউক। আগামী ছয় মাসের মধ্যে অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিষয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরিরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। 


প্রসঙ্গত, ঢাকা মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ বিধিমালা, ২০০৮)-এর বিধি ৩৪ অনুযায়ী নগর উন্নয়ন কমিটির কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব এই কমিটির সভাপতি। এ ছাড়া রাজউক চেয়ারম্যান, গণপূর্ত অধিদপ্তর, স্থাপত্য অধিদপ্তর, ডিএনসিসি, ডিএসসিসি, বুয়েট, বিআইপি, আইএবি, আইইবি, রিহ্যাব ও বাপাসহ সংশ্লিষ্ট খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা কমিটিতে রয়েছেন। 


বহাল তবিয়তে ঝুঁকিপূর্ণ ২২৯ ভবন


২০২৩ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত নগর উন্নয়ন কমিটির সভায় ২২৯টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মধ্যে ৪২টি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই সঙ্গে ১৮৭টি ভবন রেট্রোফিটিং করে ব্যবহার করার সুপারিশ করা হয়। আরবান রিজিলিয়ান্স প্রকল্পের অধীনে এসব ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে রাজউক। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে গেলেও কিছু চিঠি চালাচালি ছাড়া দৃশ্যমান কোনো কাজ করতে পারেনি রাজউক।


নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেছেন, এক বছরে শুধু ভবন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া আর মিটিং করা ছাড়া কোনো কাজ হয়নি। অথচ এসব ভবনে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করছে। দেশের অন্যতম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বিএসএমএমইউতেও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে। শিশু-কিশোরদের বিদ্যালয় থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়েও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পড়াশোনা করছেন শিক্ষার্থীরা। মাঝেমধ্যে ছোটখাটো ভূমিকম্প এবং ভবনধস নাড়া দিয়ে গেলেও টনক নড়ছে না কর্তৃপক্ষের। দুর্ঘটনার সময় লোক দেখানো কিছু কার্যক্রম পরিচালনা করে আবার থেমে যাচ্ছে সবাই।


রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন) এবং আরবান রিজিলিয়ান্স (রাজউক অংশ) প্রকল্পের পরিচালক আব্দুল লতিফ হেলালী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, আমরা ভবনগুলো চিহ্নিত করে একাধিকবার সবাইকে চিঠি দিয়েছি। অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করেছি। প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি হওয়ায় রাজউক চাইলেই কিছু করতে পারে না। 


ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকি


বাংলাদেশ ভূমিকম্পের বড় ঝুঁকিতে রয়েছে বলে বারবার সতর্ক করছেন ভূতত্ত্ববিদরা। গত বুধবার ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বড় অংশজুড়ে মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। ৫ দশমিক ৬ মাত্রার এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৪৫০ কিলোমিটার দূরে মিয়ানমারের মাওলাইকে। ভারতের ন্যাশনাল সেন্টার ফর সিসমোলজির তথ্যানুযায়ী, মিয়ানমারের স্থানীয় সময় বুধবার সন্ধ্যা ৬টা ৪৩ মিনিটে এই ভূমিকম্প হয়। এর কেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠের ১১০ কিলোমিটার গভীরে।


এর আগে গত বছর ৫ মে ভোরে ভূমিকম্প হয়। সেই কম্পনে অনেকের ঘুম ভেঙ যায়। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের হিসাবে ঢাকার অদূরে দোহারে উৎপত্তি হওয়া ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৩।


ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, সিলেট থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে কয়েকটি প্লেট থাকার কারণে বাংলাদেশে ভূমিকম্পের বড় ধরনের ঝুঁকি রয়েছে। ২০২৩ সালের আগে ঢাকায় যেসব ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশেরই উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেট বা চট্টগ্রাম অঞ্চল। অনেকগুলোর কেন্দ্র ছিল ভারতের মিজোরাম বা ত্রিপুরা রাজ্যে। কিন্তু গত বছর ৫ মে ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল দোহারে হওয়ার কারণে দুশ্চিন্তা বাড়ছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশে ৮ মাত্রা বা তার চেয়ে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেরকম ভূমিকম্প হলে ঢাকা শহরের অন্তত ছয় হাজার ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে। প্রাণহানি হবে অন্তত তিন লাখ মানুষের।


ভূমিকম্প ছাড়াও ভবনধস


গত বছর রাজধানীর সিদ্দিকবাজার ও সায়েন্স ল্যাব এলাকায় দুটি ভবন ধসে পড়ে। এতে হতাহত হলেও অন্যদের টনক নড়েনি। দুটি ঘটনার পর কয়দিন রাজউক অভিযান পরিচালনা করা হলেও কোনো ভবন সিলগালা বা রেট্রোফিটিং করার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এ দুটি ঘটনায় অন্তত ২২ জনের মৃত্যু হয়। ২০০৪ সালে পুরান ঢাকায় ভবন ধসে ১৭ জনের মৃত্যু হয়। 


তালিকায় আটকা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণের উদ্যোগ


২০০৪ সালে পুরান ঢাকার ঘটনার পর অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) ৫০০টির মতো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে। এরপর ২০১০ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করে রাজউক। ২০১৬ সালে সেটি হালনাগাদ করা হয়। সে সময় রাজধানীতে অতিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ৩২১টি ভবন চিহ্নিত করা হয়। একই বছরের ৭ জানুয়ারি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ঢাকায় ৭২ হাজার ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করার কথা জানায়। 


শেয়ার করুন