২২ নভেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ০২:৫২:৫৫ পূর্বাহ্ন
অভ্যন্তরীণ ও বেসরকারি খাতে ঋণে লাগাম
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৪-০৬-২০২৪
অভ্যন্তরীণ ও বেসরকারি খাতে ঋণে লাগাম

অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসন্ন (২০২৪-২৫) বাজেটে বেসরকারি খাতে ও অভ্যন্তরীণ মোট ঋণ সরবরাহে লাগাম টানা হবে। চলতি অর্থবছরে এই দুই খাতে যে লক্ষ্যমাত্রার প্রবৃদ্ধি রয়েছে সেখান থেকে আগামী অর্থবছরে নামিয়ে আনা হচ্ছে। একইভাবে বাজারে টাকার সরবরাহ কমানো হবে। পাশাপাশি চলতি অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণ এবং মুদ্রা সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা কাটছাঁট করে কমানো হয়েছে।


আগামী ৬ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। সেখানে বেসরকারি খাতের ঋণ ও মুদ্রা সরবরাহ এবং অভ্যন্তরীণ ঋণের নতুন লক্ষ্যমাত্রা প্রকাশ করা হবে। অর্থনীতিবিদদের শঙ্কা বেসরকারি খাতে ঋণ এবং অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবাহ কমলে এর প্রভাবে বিনিয়োগ হ্রাস পাবে। এতে কর্মসংস্থান কম হবে। আর বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়লে সার্বিকভাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে।


সূত্র মতে, চলতি অর্থবছরের চেয়ে এক শতাংশ কমিয়ে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা আগামী অর্থবছরে ৯ শতাংশ ধরা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এ খাতের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১০ শতাংশ আছে। এছাড়া আগামী অর্থবছরের ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ৯ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হয়। যদিও চলতি অর্থবছরে এর লক্ষ্যমাত্রা হলো ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। অর্থাৎ বাজার মুদ্রা সরবরাহে লাগাম টানবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি চলতি অর্থবছরের চেয়ে ২ দশমিক ২ শতাংশ কমিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ১১ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এর লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে ১৩ দশমিক ৯ শতাংশ।


অর্থ বিভাগ মনে করছে, বাজারে টাকা সরবরাহ বাড়লে মানুষের হাতে টাকা চলে আসবে। বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়লে সেটি যে কোনোভাবে টাকা বাজারে আসবে। পাশাপাশি মোট ঋণ বাড়ালে সেটির প্রভাবও পড়বে। আর বাজারে বেশি পরিমাণ টাকা চলে এলে মানুষ নানাভাবে সেটি খরচ করে। যার প্রভাবে মূল্যস্ফীতি ঘটে। এজন্য টাকা সরবরাহ কমাতে মোট ঋণ, মুদ্রার সরবরাহ ও বেসরকারি ঋণে কিছুটা লাগাম টানার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আইএমএফও বলেছে, বাজারে বেশি টাকার সরবরাহ হলে মূল্যস্ফীতি ঘটবে।


সরকারের এ উদ্যোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে জানান, এ ধরনের উদ্যোগ খুব বেশি ইতিবাচক হবে না। বরং উলটো হবে কর্মসংস্থান কমবে, লোকজনের কষ্ট বাড়বে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের ব্যবসার ক্ষতি হবে। যার নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বিনিয়োগ ও জিডিপির প্রবৃদ্ধির ওপর। আইএমএফ বলে আসছে, মূল্যস্ফীতি ঘটে যদি তাহলে টাকার সরবরাহ বেড়ে যায়। তাদের ব্যাখ্যা-ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহ বা ঋণ বেশি দেওয়া হলে মানুষের হাতে টাকা যাবে। এতে মূল্যস্ফীতি হবে। কিন্তু দেশের মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে পণ্য সরবরাহজনিত কারণে, চাহিদার জন্য নয়। পণ্য দেশে আছে, আপনি পাচ্ছেন না, কারসাজির কারণে। আবার অনেক পণ্যের উৎপাদন হচ্ছে না। কিন্তু উৎপাদন নিশ্চিত ও ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি বাড়াতে হলে ঋণ দিতে হবে। পণ্য উৎপাদন না বাড়লে মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।


চলতি অর্থবছরে বেসরকরি খাতে ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রার প্রবৃদ্ধি আছে ১০ শতাংশ। যা আগে ১১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। একাধিক ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমার অন্যতম আরও একটি কারণ হচ্ছে আমদানির পরিমাণ অনেক কমে যাওয়া। আমদানির বিপরীতে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে থাকেন। গত কয়েক মাসে আমদানি কমে যাওয়ায় বেসরকারি খাতের ঋণে এর প্রভাব পড়েছে।


এদিকে আগামী অর্থবছরে এ খাতে ঋণ প্রবাহ কমানোর ফলে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বর্তমান বিনিয়োগ পরিস্থিতি ভালো যাচ্ছে না। সরকারি বিনিয়োগ দ্রুত হারে বাড়লেও বেসরকারি বিনিয়োগ সে তুলনায় বাড়ছে না। এমনিতে দীর্ঘদিন ধরেই বিনিয়োগে শ্লথ গতি বিরাজ করছে। চলতি অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্য হচ্ছে ১১ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এই বিনিয়োগের জন্য যে পরিমাণ মেশিনারি আমদানি সেটি হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ১৭৭ কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলা হয়েছে। এটি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ শতাংশ কম। এই আট মাসে ১৫২ কোটি ডলারের কাঁচামাল ও ৩০০ কোটি ডলারের মধ্যবর্তী কাচামাল আমদানি হয়। গত অর্থবছরের এই সময়ে আমদানি হয়েছিল ১৫৮ কোটি ডলারের প্রাথমিক কাঁচামাল ও ৩৬০ কোটি ডলারের মধ্যবর্তী কাঁচামাল।


জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমানো হলে এটি অর্থনীতির জন্য মোটেও স্বস্তিকর নয়। কারণ দেশের মোট বিনিয়োগের অধিকাংশই আসে ব্যাংকিং সেক্টর থেকে ঋণ নিয়ে। আর আমাদের পুঁজিবাজার এখনো সেভাবে বিনিয়োগের কেন্দ্র হিসাবে গড়ে ওঠেনি। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা কমানোর অর্থ আগামীতে বিনিয়োগ কমে যাওয়া। আর বিনিয়োগ কমে গেলে উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান কমে যাবে। ফলে দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের যে লক্ষ্য রয়েছে, তাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শুধু তাই নয়, বাজেটে সরকার যে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, তাও অর্জন হবে না।


এদিকে বাজারে টাকা সরবরাহ কমানোর উদ্যোগ থাকছে আসন্ন বাজেটে। টাকা ছাপিয়ে ঋণ দিলেও সেখান থেকে সরে আসছে সরকার। এখন সরকার দেনা মেটাতে বন্ড দিচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। সেই বন্ডের বিপরীতে টাকা দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু আগামী অর্থবছরে ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহ হ্রাস করার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে ব্যাংক খাতে ছাপানো টাকার পরিমাণ (রিজার্ভ মানি) ছিল ৩ লাখ ৭২ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। নভেম্বর মাসে যা ছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক মাসেই ছাপানো টাকার পরিমাণ বেড়েছে ৩১ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। ডিসেম্বরে মুদ্রা সরবরাহ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, সংকটে পড়া ইসলামি ও প্রচলিত ধারার সাতটি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো দেখাতে একদিনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা ধার দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতেই বেড়ে যায় মুদ্রা সরবরাহ।


সেই টাকা ফেরত আসায় জানুয়ারিতে রিজার্ভ মানি বা মুদ্রা সরবরাহ কমে হয় ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। তবে ফেব্রুয়ারিতে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে হয় ৩ লাখ ৫২ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। গত মার্চে মুদ্রা সরবরাহ আরও বেড়ে হয় ৩ লাখ ৫৬ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। ফলে আগামীতে এ পরিকল্পনায় হাঁটবে না সরকার। টাকা সরবরাহ ব্যবস্থা টেনে ধরা হবে।


আগামী অর্থবছরে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণ নেওয়া হবে ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। দেশি ঋণের মধ্যে ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে। বাকি ২০ হাজার কোটি টাকা নেওয়া হবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও অন্যান্য উৎস থেকে।


শেয়ার করুন