০৭ জুলাই ২০২৪, রবিবার, ০৭:৪১:১০ অপরাহ্ন
কোরবানির পশুর ফেলনা অঙ্গে বাড়ছে রপ্তানি আয়
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৬-০৬-২০২৪
কোরবানির পশুর ফেলনা অঙ্গে বাড়ছে রপ্তানি আয়

কোরবানির পর পশুর ফেলে দেওয়া নাড়িভুঁড়ি, পাকস্থলী, লিঙ্গ, শিংসহ বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এখন আর মূল্যহীন নয়। এসব অঙ্গেরও এখন আর্থিক মূল্য রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এগুলো রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন দেশের তরুণ উদ্যোক্তারা। সারা বছরই জবাই করা পশুর ফেলে দেওয়া এ সব অঙ্গ সংগ্রহ ও রপ্তানি করা হলেও মূলত কোরবানি ঈদেই সবচেয়ে বেশি সংগ্রহ করা হয়। ভিয়েতনাম, হংকং, চীন, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে এসব পণ্য।


এসব দেশে প্রতিবছরই চাহিদা বাড়ছে। ফলে চলতি বছরেও ভালো আয়ের মুখ দেখেছে সম্ভাবনাময় এ খাতটি। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম এগারো মাসের রপ্তানি আয় এরই মধ্যে অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। তবে চাহিদা থাকার পরও সচেতনতার অভাবে এসব পণ্য কাক্সিক্ষত পরিমাণে সংগ্রহ করা যাচ্ছে না বলে তারা জানিয়েছেন।


রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম এগারো মাসে (জুলাই থেকে মে পর্যন্ত) লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এরই মধ্যে ২৭ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি রপ্তানি হয়েছে। এ সময় রপ্তানি হয়েছে ৯ দশমিক ৮২ মিলিয়ন ডলার। যেখানে এই সময়ে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ৭২ মিলিয়ন ডলার। আর গোটা অর্থবছরের (জুলাই থেকে জুন) জন্য লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল সাড়ে ৮ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরে ১১ মাসে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে, তা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে।


ইপিবির হিসাব অনুযায়ী, আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম এগারো মাসে ২ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন ডলার বা ৩৩ দশমিক ৪২ শতাংশ বেশি আয় হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি হয় ৭ দশমিক ৩৬ মিলিয়ন ডলার। আর গত অর্থবছরের ১২ মাসে এ খাতে রপ্তানি আয় ছিল ৭ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ সবদিক থেকেই চলতি অর্থবছরে রপ্তানি আয় ভালো অবস্থানে রয়েছে।


খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, অপ্রচলিত এসব পণ্যের মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে গরুর পাকস্থলীর (স্থানীয়ভাবে সাতপল্লা হিসাবেও পরিচিত) রপ্তানি সবচেয়ে বেশি। আন্তর্জাতিক বাজারে এটি ‘ওমাসম’ নামে পরিচিত। পণ্যটির বিপুল পরিমাণে অগ্রিম অর্ডার পাচ্ছেন রপ্তানিকারকরা। তাছাড়া বছরের শেষ দিকে রপ্তানি অনেকখানি বৃদ্ধি পায়।


এরপর রয়েছে গরুর লিঙ্গ, যা পিজল নামে পরিচিত। তবে এটির সংগ্রহ খুব কম। তারপরও হংকং ও ভিয়েতনামে নিয়মিত যাচ্ছে এবং ভালো দাম পাওয়া যায়। এছাড়া শিংসহ অন্যান্য অঙ্গও রপ্তানি হয়। তবে তা সামান্য পরিমাণে। অতীতে হাড় রপ্তানি হলেও বর্তমানে তা বন্ধ রয়েছে বলে জানান রপ্তানিকারকরা। মূলত রপ্তানি আয়ে বড় ভূমিকা রাখছে ওমাসম ও পিজল।


রপ্তানিকারকরা জানান, বিশ্ববাজারে ছোট-বড় আকারভেদে প্রতি কেজি ওমাসমে সাড়ে ৪ থেকে ৬ ডলার পর্যন্ত দাম পাওয়া যায়। অপরদিকে পিজলের কেজিপ্রতি ২২ ডলার থেকে শুরু করে আকার ও মানভেদে বিভিন্ন দাম পাওয়া যায়।


কথা হলে ওমাসম ও পিজল রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান জোরাক ট্রেড সোর্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরশাদ হোসেন শালিম বলেন, গরুর ওমাসমের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ থেকে বছরে কমবেশি ৫০ কনটেইনার রপ্তানি হয়। প্রতি মাসে অন্তত ৪ কনটেইনার ওমাসম বিদেশে যাচ্ছে। এসব পণ্যের বড় বাজার হচ্ছে চীন। তবে চীনের কিছু নিয়ম-কানুনের কারণে সরাসরি সেখানে রপ্তানি করা যাচ্ছে না জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আমরা মূলত হংকং ও ভিয়েতনামে কাঁচা পণ্য হিসেবে রপ্তানি করি। সেখান থেকে এগুলো প্রক্রিয়াজাত হয়ে চীনে যায়। এছাড়া থাইল্যান্ডসহ আরও কয়েকটি দেশে রপ্তানি হয়। ওমাসম লবণ দিয়ে সংগ্রহ করতে হয়। তবে পিজলের ক্ষেত্রে সেটার দরকার হয় না।


আরেক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান সেভেন স্কাইস ট্রেডিং অ্যান্ড ডিসট্রিবিউশনের কমার্শিয়াল এক্সিকিউটিভ মো. হেদায়তুল্লাহ বলেন, এসব পণ্যেরও যে গুরুত্ব আছে বা বিক্রি হয় তা অনেকেই জানেন না। ফেলে দেওয়া হয়। অথচ এগুলো সঠিকভাবে সংগ্রহ করে আমাদের কাছে আনলে তারাও দাম পেতেন, আমাদেরও সংগ্রহ বাড়ত। শুধু সচেতনতা ও প্রচারণার অভাবে আমাদের পণ্য সংগ্রহে ঘাটতি থাকে। আমাদের নিজস্ব চেইন থাকলেও হাত বদলের কারণে খরচও বেশি পড়ছে।


প্রতি কোরবানির ঈদে সাতপল্লা ও গরুর লিঙ্গ সংগ্রহ করেন হাজারীবাগের ব্যবসায়ী মো. সেলিমসহ এখানকার আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী। সেলিম জানান, অন্য সময়ে চেয়ে কোরবানির সময় বিপুল সংগ্রহ হয়। পিস হিসাবে প্রতিটি সাতপল্লা ২০০ থেকে ২৪০ টাকা এবং লিঙ্গ ৬০ থেকে ১২০ টাকা দরে কিনে পরিষ্কার ও চর্বি ছাড়িয়ে সামান্য লাভ রেখে বিক্রি করেন তারা। এতে ভালো আয় হয় তাদের।


প্রতিবছর ৭ থেকে ৮ টন পিজল রপ্তানি করছে বিসমিল্লাহ্ ট্রেডার্স। প্রতিষ্ঠানটির কমার্শিয়াল এক্সিকিউটিভ মো. সোহেল বলেন, পণ্য সংগ্রহে নিজস্ব চেইন থাকার পরও অর্ডার মেটাতে কাক্সিক্ষত সংগ্রহ হয় না। সাধারণ মাসে ১০ হাজার পিসও হয় না। তবে কোরবানির সময় ৮০ থেকে ৯০ হাজার পিস সংগ্রহ হয়। সংগ্রহ ভালো হওয়ায় সবমিলিয়ে এ বছর ১০ টনের কাছাকাছি রপ্তানি করতে পারব বলে আশা করছি।


জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ১২টি প্রতিষ্ঠান এ ধরনের পণ্য রপ্তানি করছে। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার আগে আরও অনেক প্রতিষ্ঠান ছিল, যেগুলো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেছে। রপ্তানিতে ভালো করলেও নানা প্রতিবন্ধকতায় ব্যবসায়ীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।


জোরাক ট্রেড সোর্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরশাদ বলেন, রপ্তানির পরিমাণ কম হলেও নিয়মিত চাহিদা রয়েছে, যেটা বাড়ছে। এ খাতের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু শুল্ক-করের বোঝা ও রপ্তানি প্রক্রিয়ায় ভোগান্তি থাকায় উদ্যোক্তারা প্রতিনিয়ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। অথচ সহযোগিতা পেলে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব।


শেয়ার করুন