২১ নভেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৬:০০:৪৬ অপরাহ্ন
বিএমডিএর কেনাকাটা: তিন হাজার টাকার ফ্যান ১০ হাজারে
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-০৬-২০২৪
বিএমডিএর কেনাকাটা: তিন হাজার টাকার ফ্যান ১০ হাজারে

এক টাকা দামের প্রতিটি খাম কেনা হয়েছে ৯ টাকায়। আর ৩ টাকার খাম ১৩ টাকায়। বাজারে ১২৮ জিবির যে পেনড্রাইভের দাম ১ হাজার টাকা, তা কেনা হয়েছে আড়াই হাজারে। ৩ হাজার ৩০০ টাকার ইউপিএসের দাম ধরা হয়েছে ৬ হাজার টাকায়। আর ৩ হাজার টাকার ওয়াল ফ্যান ৯ হাজার ৯০০ টাকা দরে কেনা হয়।


বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) বিভিন্ন প্রকল্পে কোটেশনের মাধ্যমে কেনাকাটায় এমন অস্বাভাবিক দাম দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশে প্রকল্প পরিচালকেরা (পিডি) অস্বাভাবিক মূল্য পরিশোধ করে নিজেদের কমিশন বাগিয়ে নেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে মালপত্র বুঝে না নিয়ে শুধু কাগজ-কলমে কেনাকাটা দেখিয়ে বিপুল টাকা আত্মসাৎ করারও অভিযোগ রয়েছে।


২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিএমডিএর বিভিন্ন প্রকল্পের পরিচালক ও দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলীরা ৫৮ লাখ ৫১ হাজার ৩৮৬ টাকার কেনাকাটা করেছেন শুধু কোটেশন বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে।


নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, বিএমডিএর ইআইইসিডি প্রকল্পের পরিচালক শহিদুর রহমান গত বছরের ১৯ জুন একটি কোটেশন বিজ্ঞপ্তি দেন। কমডেক্স ইনফরমেশন টেকনোলজি নামের একটি প্রতিষ্ঠান ৬ হাজার টাকায় একটি ইউপিএস, আড়াই হাজার টাকায় পেনড্রাইভ, ৩ হাজার ৬০০ টাকায় র‌্যাম ও সাড়ে ৩ হাজার টাকায় সিপিইউ ক্যাসিংসহ অন্যান্য মালপত্র সরবরাহ করে।


মডেল অনুযায়ী অনলাইন বাজার যাচাই করে দেখা গেছে, পাওয়ার গার্ডের ওই ইউপিএসের দাম বাস্তবে ৩ হাজার ৩৯০ টাকা, ক্যাসিংয়ের দাম ২ হাজার ৩০০ টাকা এবং ১২৮ জিবি পেনড্রাইভের দাম মাত্র ১ হাজার টাকা। কোটেশনেই এসব দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন পিডি।


পিডি শহিদুর রহমান ৩ হাজার ৩৯০ টাকার যে ইউপিএস কিনেছেন ৬ হাজার টাকায়, সেই একই ইউপিএস আরেক কোটেশনের মাধ্যমে ৪ হাজার ৯০০ টাকায় কিনেছেন এইচভিসিপি প্রকল্পের পিডি এটিএম রফিকুল ইসলাম। চার্টার্ড কম্পিউটার নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর পিডি রফিকুল ইউপিএসের সঙ্গে ৬৯ হাজার ৮৫০ টাকায় এইচপির কোরআই-৩ প্রসেসরের একটি ল্যাপটপও কিনেছেন। বাজারে এর দাম ৬০ হাজারের বেশি নয়। এই পিডি সাইম প্রোডাক্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ২৫০ পিস ক্যাপ কিনেছেন ১২৯ টাকা দরে। বাস্তবে এই ক্যাপগুলোর দাম ৫০ টাকার বেশি নয়।


নথিতে আরও দেখা যায়, সেচ অবকাঠামো পুনর্বাসন প্রকল্পের পিডি নূর ইসলাম ২০২২ সালের ২২ ডিসেম্বর নাভানা ফার্নিচার থেকে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৩০৫ টাকার আসবাবপত্র কেনেন কোটেশনের মাধ্যমে। এ ছাড়া গত বছরের ২২ নভেম্বর বিসমিল্লাহ মেট্রো অটোমোবাইলস থেকে কোটেশনে জিপের যন্ত্রাংশ কেনেন ২ লাখ ৬৫ হাজার ৭০ টাকার। এই পিডি কমডেক্স ইনফরমেশন টেকনোলজির কাছ থেকে কোটেশনের মাধ্যমে গত বছরের ১৭ অক্টোবর ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪৩০ টাকার কম্পিউটার সামগ্রী কিনেছেন।


আবার আরেক প্রকল্প পরিচালক নাজিরুল ইসলাম গত বছরের ১৯ জুন চার্টার্ড কম্পিউটার থেকে ৮৫ হাজার টাকা দামের তিনটি ফটোকপি মেশিন কিনেছেন প্রতিটি ১ লাখ ১৯ হাজার ৯৪৫ টাকায়। এ ক্ষেত্রে তিনটি ফটোকপি মেশিনের জন্য বাড়তি বিল পরিশোধ করা হয়েছে ১ লাখ ৪ হাজার ৮৩৫ টাকা।


বিএমডিএর এইচভিসি প্রকল্পের পিডি সেলিম কবীর চলতি বছরের ২১ মার্চ একসঙ্গে ১৪ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকার মালামাল সরবরাহের কার্যাদেশ দেন সিটি কম্পিউটার নামের চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক প্রতিষ্ঠানকে। গত ২ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানটি মালামাল সরবরাহের যে বিল দাখিল করেছে, তাতে কোনো পণ্যের মডেল উল্লেখ করেনি।


পিডি সেলিম কবীর ঢাকার ডিলাইট নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোটেশনে ৪ লাখ ৯৫ হাজার ৩৫০ টাকার ম্যানুয়াল, নোটবুক, অফিস ফাইল ও খাম কিনেছেন। বাজারে খাকি রঙের ছোট যে খাম পাওয়া যায় ১ টাকায়, সেই খাম তিনি কিনেছেন প্রতিটি ৯ টাকা দরে। আর ৩ টাকা দামের এ ফোর সাইজের খাম কেনা হয়েছে প্রতিটি ১৩ টাকা দরে।


পিডি সেলিম কবির গত বছরের ২২ নভেম্বর আরেকটি কোটেশন বিজ্ঞপ্তিতে মিন্টু এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মোট ৩ লাখ ১৪ হাজার টাকার মালপত্র কেনেন। সেখানে ৩ হাজার টাকার ওয়াল ফ্যান ৯ হাজার ৯০০ টাকা দরে কেনা হয়।


পিডিরা যা বলেন

অস্বাভাবিক এই দাম নিয়ে জানতে চাইলে পিডি সেলিম কবীর বলেন, ‘আমরা সব ব্র্যান্ডের ভালো জিনিসটা কিনি। এগুলোর কোয়ালিটি আছে। সে কারণে দাম একটু বেশি।’

আরেক পিডি নূর ইসলামের কেনা বিভিন্ন পণ্যের বাজারদর আর পরিশোধিত দরের পার্থক্য শুনে বলেন, ‘আমরা এ দামেই কিনেছি। আপনি একটু অফিসে আসেন। সাক্ষাতে এ বিষয়ে কথা বলব।’


পিডি শহিদুর রহমান ফোন না ধরার কারণে অভিযোগের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।


ঠিকাদারদের ভাষ্য

অস্বাভাবিক দামে ১৪ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকার মালামাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিটি কম্পিউটারের স্বত্বাধিকারী মাসুদ আলম বলেন, কোন জিনিসটা কত দামে দেওয়া হয়েছে তা খাতা না দেখে তিনি বলতে পারবেন না। পরে আবার যোগাযোগ করা হলে তিনি সাড়া দেননি।


বিএমডিএতে নিয়মিত কোটেশনের মাধ্যমে মালামাল সরবরাহ করেন এমন একজন ঠিকাদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকেই বিল বেশি করে দিতে বলা হয়। বিল তোলার সময় বিভিন্ন জায়গায় আবার খরচাপাতি দিতে হয়।


অসহায় নির্বাহী পরিচালক

পিডিদের প্রশ্নে কিছুটা অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক আব্দুর রশীদ। তিনি বলেন, ‘আমরা যথাসাধ্য দেখার চেষ্টা করি যেন বাজারদরেই পণ্য কেনা হয়। এর ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে সেটা দেখব।’


শেয়ার করুন