২৪ নভেম্বর ২০২৪, রবিবার, ০৯:১৭:৪০ পূর্বাহ্ন
৮ দফা দাবিতে রাস্তায় হিন্দু সম্প্রদায়, কী আছে তাতে
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-১০-২০২৪
৮ দফা দাবিতে রাস্তায় হিন্দু সম্প্রদায়, কী আছে তাতে

চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে শুক্রবার সনাতন সম্প্রদায়ের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আট দফা দাবি তুলে ধরা হয়। সমাবেশটি সাধু সন্তদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হওয়ায় বিশেষ তাৎপর্য পেয়েছে এবং এতে বিপুল সংখ্যক হিন্দু সম্প্রদায়ের উপস্থিতি গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দাবি আদায়ের জন্য ঢাকা অভিমুখে লংমার্চের ঘোষণাও দেওয়া হয় সমাবেশ থেকে।


সমাবেশের প্রধান বক্তা চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রক্ষ্মচারী বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আমরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি। এটি কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন নয়; আমাদের দাবি হল সব নাগরিকের মধ্যে সমান মর্যাদা ও অসাম্প্রদায়িকতা।’  তিনি আরও জানান, এই দাবিগুলোর মধ্যে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের দাবি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সনাতন জাগরণ মঞ্চের সমন্বয়ক কাঞ্চন আচার্য বলেন, ‘গত ৫৩ বছরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার কোনো বিচার হয়নি।’ ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের অধিকার সমান এবং সরকারের দায়িত্ব তা রক্ষা করা।’


আট দফায় কী বলা হয়েছে


শুক্রবারের সমাবেশ থেকে যে আট দফা দাবি জানানো হয়েছে তার মধ্যে আছে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করে সংখ্যালঘু নির্যাতনে জড়িতদের উপযুক্ত শাস্তি, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন এবং অবিলম্বে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা।


প্রসঙ্গত, এক দশকের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার বেশ কিছু ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও দৃষ্টি কেড়েছিল। ২০২১ সালে দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লার একটা পূজামণ্ডপে কুরআন পাওয়ার অভিযোগ ঘিরে দেশজুড়ে মন্দির মণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটেছিল।


মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে পরবর্তী নয় বছরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সাড়ে তিন হাজারের বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে।


এসব হামলার মধ্যে হিন্দুদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং পূজামণ্ডপ, মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ অন্যতম।


চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রক্ষ্মচারী বলছেন, একটি ঘটনাতেও কোনো ব্যক্তিকে বিচার শেষ করে শাস্তি দেওয়া হয়নি।


তিনি বলেন, ‘বরং আমাদের ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত করলে জামিন পায়। আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুভূতির কথা বলে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়। আমরা কিছু বললে আমাদের একটি দলের ট্যাগ দেওয়া হয়। অন্য দেশের ট্যাগ দেওয়া হয়।’


তাদের ৮ দফার অন্য দাবি গুলো হলো- সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন, হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকে হিন্দু ফাউন্ডেশনে উন্নীতকরণ, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টকেও ফাউন্ডেশনে উন্নীতকরণ, দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন এবং অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন বাস্তবায়ন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপাসনালয় নির্মাণ ও হোস্টেলে প্রার্থনা রুম, সংস্কৃত ও পালি শিক্ষা বোর্ড আধুনিকায়ন এবং দুর্গাপূজায় পাঁচ দিন ছুটি দেওয়া।


কাঞ্চন আচার্য বলছেন, তারা ইতোমধ্যেই তাদের দাবিগুলো নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করেছেন।


তিনি বলেন, ‘এবারের দুর্গাপূজার সময় সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা হয়েছে কিন্তু এখনো তাতে কোনো অগ্রগতি আসেনি।’


এখন কেন রাস্তায়


শুক্রবার লালদীঘিতে সনাতন সম্প্রদায়ের সমাবেশের পর সামাজিক মাধ্যমে অনেক নিয়ে এ নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন তুলেছেন। কেউ কেউ বলছেন আওয়ামী লীগ আমলে সনাতন সম্প্রদায়ের মানুষেরে এভাবে সোচ্চার হয়নি।


আবার কেউ কেউ সনাতন সম্প্রদায় ‘আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে’ এমন মন্তব্য করছেন।


চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রক্ষ্মচারী বলছেন, সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নকে বৈধতা দিয়ে এগুলো পুরনো কৌশল বলেই তারা মনে করেন।


তিনি বলেন, ‘আমরা যে সরকারের আমলেই হোক যত অন্যায়ের শিকার হয়েছি তার বিচার চাই এবং সুরক্ষা নিশ্চিতের দাবি করছি। সরকার মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ৫০০ মসজিদ করেছে। আমরা একে স্বাগত জানিয়েছি কিন্তু অন্য ধর্মের জন্য কি করেছে?’ 


চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রক্ষ্মচারী আরও বলেন, ‘আমরা এখন রাস্তায় নেমেছি কারণ এখন পরিবর্তনের কথা বলা হচ্ছে। তবে কিছু ঘটনা আমাদের বিচলিত করেছে। আগের বাড়িঘর মন্দির বা ব্যক্তির ওপর হামলা হয়েছে নিয়মিত। এখন জীবিকায় হাত দেওয়া হচ্ছে। শুধু হিন্দু বলেই চাকরিচ্যুত ও পদাবনতির ঘটনা ঘটছে। বিভিন্ন জায়গায় আমাদের অনুষ্ঠানে বাধা দেয়া হচ্ছে। এসব কারণে আমাদের প্রতিবাদ করতে হচ্ছে।’


তিনি জানান, তারা ইতোমধ্যেই বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে তাদের দাবির বিষয়ে মতবিনিময় করেছেন।


তিনি বলেন, ‘সরকার ছয়টি কমিশন করেছে কিন্তু সেই কমিশনে তো সংখ্যালঘু বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নেই। আমরা চাই আমরা যেন আমাদের কথা তুলতে পারি।’


সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিই লক্ষ্য?


হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের দাবি, ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার জন্য কমিশন হলেও আওয়ামী লীগ সরকার পনের বছরে তার ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি সে সময় চট্টগ্রামে অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরী হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে আলোচনা তৈরি করলেও এখন পর্যন্ত সেই ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার হয়নি।


২০০৬ সালে রাউজানে জ্ঞানজ্যোতি হত্যাকাণ্ড ও ২০১২ সালে রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন তুললেও সেগুলোতেও বিচার হয়নি কারও।


ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর ছবি পোস্টের অভিযোগ তুলে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নাসিরনগরে পনেরটি মন্দির ও তিন শতাধিক বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় হলেও এর আট মামলার সাতটিরই বিচার কাজ শেষ হয়নি।


২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর ১২টি বৌদ্ধ বিহার, উপাসনালয়ে অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। একইসঙ্গে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ৩০টি বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সোচ্চার হয়েছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও।


আওয়ামী লীগ আমলে এসব নিয়ে তারা মাঠে নামেননি কেন এমন প্রশ্নের জবাবে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রক্ষ্মচারী বিবিসিকে বলেন, তারা সবসময়ই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।


তিনি আরও বলেন, ২০২১ সালের ঘটনাতেও দেশজুড়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছি আমরা। ১৫৪ টি দেশে ওই ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়ে তখন। 


যদিও সামাজিক মাধ্যমে সরকার সমর্থকরা অনেকে প্রচার করছেন যে সনাতন ধর্মের মানুষ আওয়ামী লীগকে সুবিধা দেয়ার জন্য এখন রাস্তায় নেমেছে।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রক্ষ্মচারী বলেন, ‘এটি আক্রমণকারী ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর পুরনো খেলা। এ কারণেই আমরা সরকাররে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি। কারণ দেশকে সঠিক পথে নিতে হলে সবার সাথেই সমান আচরণ করতে হবে এবং সবাইকে সমান সম্মান ও নিরাপত্তাবোধ নিশ্চিত করতে হবে।’


তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক রং দিয়ে উপেক্ষা করার প্রবণতার কৌশল পুরনো। আমরা কিছু বললে ভারতের প্রসঙ্গ টানা হয়। আমরাও বলতে চাই যে পাকিস্তানেও তো সংখ্যালঘু কমিশন ও মন্ত্রণালয় আছে। তাহলে বাংলাদেশে কেন থাকবে না?’


চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রক্ষ্মচারী বলেন, ‘মনে রাখতে হবে যে বিশ্বের কোথাও একজন মুসলিম ক্ষতিগ্রস্ত হলে যেমন সারাবিশ্বের মুসলিমদের মন কাঁদে, তেমনি একজন হিন্দুর ক্ষতি হলে সারা বিশ্বের হিন্দুদের মন কাঁদবে। ‘ 


সমাবেশে আরও যা বলা হয়েছে


শুক্রবার লালদীঘি ময়দানের ওই সমাবেশে প্রধান বক্তা ছিলেন অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী। তিনি বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ও পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ।


সেখানে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘কেউ যদি আমাদের উৎখাত করে শান্তিতে থাকার চেষ্টা করেন, তাহলে এ ভূমি আফগানিস্তান হবে, সিরিয়া হবে।’


তিনি বলেন, ‘শুধু সংখ্যালঘু পরিচয়ে ৯৩ জনকে পুলিশের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ভেটেরিনারি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দুদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। মাঝখানে কিছুদিন এমন অপকর্ম থেমে গিয়েছিল। এখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। আমরা আর নীরব থাকব না।’


তিনি আরও বলেছেন, ‘বাংলাদেশে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আমাদের আপত্তি নাই। কিন্তু দ্বিতীয়/তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে সংবিধান সংশোধনকে মানব না। পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি হিন্দু হয়েছেন। আর এ দেশে একজন করে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছেন।’


শেয়ার করুন