২৮ অক্টোবর ২০২৪, সোমবার, ১০:২৯:৫৭ অপরাহ্ন
বাংলাদেশ-ভারতকে যে বার্তা দিলো আমেরিকা
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৮-১০-২০২৪
বাংলাদেশ-ভারতকে যে বার্তা দিলো আমেরিকা

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে এখন নানামুখী আলোচনা। বিশেষ করে ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার পতন এবং পালিয়ে দিল্লিতে আশ্রয় নেয়ার পর থেকে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্পর্ক টানাপড়েনের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনার প্রতি ভারতের অন্ধ সমর্থন এখনো বহাল। দিল্লি ডান-বাম না দেখে গত ১৫ বছর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের শাসনেই ভরসা রেখেছে। হাসিনার শাসনামলে নানা ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন ছিল গণতান্ত্রিক বিশ্বে।সাপ্তাহিত রাজনৈতিক ম্যাগাজিন জনতার চোখে মিজানুর রহমানের প্রকাশিত এক রচনায় বিষয়টি উঠে আসে।


যেখানে বলা হয়- গুম-খুন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, মানুষের বাক- স্বাধীনতা তথা ভোটের অধিকার হরণের সমালোচনা ছিল দুনিয়া জুড়ে। কিন্তু ভারত শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার পক্ষেই থেকেছে। একটি দলকে ক্ষমতায় রাখতে গিয়ে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী বাংলাদেশকে হারানোর ঝুঁকি নিতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি ভারতের (বাইপার্টিজান) নেতৃত্ব। সীমান্তে গুলি-হত্যার ঘটনা আগেও ঘটেছে। এখনো ঘটছে। কিন্তু আগে বেশির ভাগ গুলি হতো চোরাকারবারিদের টার্গেট করে। নিরীহ শিশু-কিশোর কিংবা নারীকে হত্যার ঘটনা ফেলানী ছাড়া বিরল। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সীমান্তে সংঘটিত দু’টি লোমহর্ষক ঘটনা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এ নিয়ে ঢাকায় ভারতীয় দূতকে তলব করা হয়েছে। এটাও নজিরবিহীন। উভয় সরকারের বক্তৃতা-বিবৃতিতে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। সরকারি চিঠিপত্রে বেশ শক্ত ভাষার ব্যবহার হচ্ছে। এ সবই দু’দেশের সম্পর্ক তিক্ততার চরমে পৌঁছার ইঙ্গিত। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের বক্তব্যও ভালোভাবে নিচ্ছে না ভারত। তারা নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ঢাকায় ভিসা কার্যক্রম শিথিল রেখেছে। এতে অনেক বাংলাদেশি জরুরি চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। দেশটির ঋণে বাংলাদেশে গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। কর্মীরা কাজে যোগদানে অনীহা দেখাচ্ছেন। যদিও এ নিয়ে দিল্লিকে দফায় দফায় অনুরোধ করে চলেছে ঢাকা। এই যখন অবস্থা তখন সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আগ্রহী হয়েছে উভয়ের বন্ধুরা। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্র্বতী সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য সমর্থন রয়েছে। অনেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পেছনে ওয়াশিংটনের ভূমিকা থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করেন। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের তরফে কখনোই তা স্বীকার করা হয়নি। বরং বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বা বাইরের শক্তি নয়, বাংলাদেশের মানুষই বুকের তাজা রক্ত ঢেলে ‘রেজিম চেঞ্জ’ করেছে। এটা অস্বীকারের জো নেই যে, আওয়ামী শাসনে দেশের বেশির ভাগ মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। খোদ আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীরাও। তারা পরিস্থিতির পরিবর্তন চেয়েছিলেন।


তবে শেখ হাসিনার এমন শোচনীয় পরাজয় চাননি। দেশত্যাগ তো নয়ই। সমালোচনা রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি বন্ধু-উন্নয়ন অংশীদারদের আপত্তি অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশের গত ৩টি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে সমর্থনই কাল হয়েছে ভারতের। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় ছিল বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা আর ভারত বিরোধিতাকে সমার্থক বানিয়ে প্রচার! শেখ হাসিনা সরকার তার গদি ধরে রাখতে ভারত বিরোধিতাকে ‘কার্ড’ হিসেবে ব্যবহার করেছে যথেচ্ছ ভাবে।


যা সরকারের পাশাপাশি ভারতের প্রতি মানুষকে বিষিয়ে তুলেছে। এটা বাংলাদেশে ভারত বিরোধিতাকে উস্কেই দেয়নি বরং ‘নতুন মাত্রা’ দিয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে নানা মিথ রয়েছে। এক সময় বলা হতো দিল্লির চোখেই বাংলাদেশকে দেখে যুক্তরাষ্ট্র! এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রথম প্রশ্ন উঠে ট্রাম্প জমানায়। সেই সময়ে রিপাবলিকান সরকারের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন ই বিগান বাংলাদেশ সফর করেন। ঢাকা আসার আগে তিনি দিল্লিতে ছিলেন ৩ দিন। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের শক্ত উপস্থিতি বোঝাতে গিয়ে দিল্লিতে দেয়া বক্তৃতায় বিগান ‘এলিফ্যান্ট ইন দ্য রুম’ অর্থাৎ ‘হাতি ঘরে ঢুকে গেছে’- এমন শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেন। ঢাকায় তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে অনুষ্ঠিত যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বিগান এটা স্পষ্ট করেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক চায়। অন্য দেশের মাধ্যমে নয়। সেদিন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির সেন্টার পিস বা কেন্দ্রে বাংলাদেশের অবস্থানের বিষয়টিও খোলাসা স্টেট ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবস্থানে থাকা কর্মকর্তা স্টিফেন।


বিশ্লেষকরা মনে করেন, ওয়াশিংটন নিজের লেন্সে ঢাকাকে দেখলেও ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনায় বাংলাদেশ নিয়ে কথা হবে- এটা অনাকাঙ্ক্ষিত নয়। এ অঞ্চলে চীনকে ঠেকাতে ‘কোয়াড’ নামের চতুর্দেশীয় যে জোট রয়েছে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বস্ত সহযোগী ভারত। সামরিক ওই জোটে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে পেন্টাগন এবং দিল্লির চাওয়া অভিন্ন। কূটনৈতিক সূত্র বলছে, বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে ভারতের উদ্বেগের বিষয়টি অন্তর্র্বতী সরকারের কাছে দফায় দফায় তুলে ধরেছে যুক্তরাষ্ট্র। দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে যুক্তরাষ্ট্র রীতিমতো দূতিয়ালি করছে। গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফর করে উচ্চ পর্যায়ের একটি মার্কিন প্রতিনিধিদল। ওই দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডনাল্ড লু। বাংলাদেশ সফরের আগে ৩ দিন তিনি দিল্লিতে কাটান। ঢাকা সফর শেষ করে দিল্লি হয়েই ওয়াশিংটন ফিরেন। ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে নতুন সরকারের আমলে এটাই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের কোনো প্রতিনিধিদলের প্রথম সফর। ওই সফরকে ঘিরে শুধু ঢাকা, ওয়াশিংটনই নয়, দিল্লিসহ কূটনৈতিক মহলে ছিল ব্যাপক কৌতূহল। বিশেষ করে পাকিস্তানে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ভূমিকা রয়েছে মর্মে প্রচার থাকা কূটনীতিক ডনাল্ড লু’র দিল্লি হয়ে ঢাকায় আসা এবং কী বার্তা বিনিময় করছেন তাতে আগ্রহ ছিল সবার। কিন্তু তখনো বিষয়টি পুরোপুরি খোলাসা হয়নি। ওয়াকিবহাল সূত্র বলছে, ডনাল্ড লু’র বার্তা বিনিময়ের রেশ ধরেই জাতিসংঘ অধিবেশনের সাইড লাইনে বসেছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং ভারতের বিদেশমন্ত্রী। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এবং নতুন পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনারের বৈঠকও সেই প্রক্রিয়ার অংশ। সূত্র মতে, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক যেন আর অবনতি না ঘটে বরং এটি দিনে দিনে স্বাভাবিক এবং উন্নত হয়, সেই দূতিয়ালি করছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে ‘শেখ হাসিনা’ এখন বড় ইস্যু। সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত ঢাকা-দিল্লি যেসব বৈঠক হয়েছে তার কোথাও শেখ হাসিনার স্ট্যাটাস বা অবস্থান নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। দু’পক্ষই বিষয়টি সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে ইস্যু যাই থাক, সম্পর্কের স্বার্থে যেনো তা যতটা সম্ভব এড়িয়ে যাওয়া যায়। এটাই উভয়ের প্রতি ওয়াশিংটনের বার্তা।


স্মরণ করা যায়, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখা বিশেষ করে কোনো ইস্যুতে যেনো দিল্লির সঙ্গে ওয়াশিংটনের ভুল বুঝাবুঝি না হয় সে বিষয়ে বরাবরই সতর্ক যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৪ সালে শেখ হাসিনা সরকার যখন নিজের অধীনে নির্বাচনের ব্যাপারে অনড় তখন ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন ড্যান ডব্লিউ মজিনা। সেই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছিল ঐকমত্যের ভিত্তিতে এমন ম্যাকানিজম বের হোক যার অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে। জাতিসংঘ তৎপর ছিল সেই মধ্যস্থতায়। জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকায় সরকার ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে নিয়ে এক টেবিলে তিন দফা বৈঠক করেছিলেন। পশ্চিমা ওই প্রক্রিয়ায় ভারতের সমর্থন আদায়ে রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনাকে দিল্লি পাঠিয়েছিল তৎকালীন ওবামা প্রশাসন। কিন্তু ভারত সেদিন শেখ হাসিনার ছকেই নির্বাচনের পক্ষে সায় দেয়। দিল্লির বিদেশ সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশে উড়ে এসে তাদের অবস্থানের জানান দিয়েছিলেন। ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করলেও ’১৮-র নির্বাচনে ভারতের মধ্যস্থতায় অংশ নেয় বিরোধী জোট। যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেন। বলাবলি আছে ওই নির্বাচনে বিএনপি শেষ পর্যন্ত দাঁড়াতে পারলে ৭০-৮০ আসনে জয় পেতো। কিন্তু লাভ হয়নি, দিনের ভোট রাতেই হয়ে গেছে।


শেয়ার করুন