০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, বুধবার, ০২:৩৭:৩৮ অপরাহ্ন
এস আলমের পরিবারের ৩৫০ ব্যাংক হিসাবের সন্ধান
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-১২-২০২৪
এস আলমের পরিবারের ৩৫০ ব্যাংক হিসাবের সন্ধান

গত ১৫ বছরে বিদেশে পাচার হওয়া মোটা অঙ্কের অর্থ দেশে ফেরত আনতে কাজ করছে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে গঠিত টাস্কফোর্সে আছেন ১১টি সংস্থার প্রতিনিধি। বিদেশি বিশেষজ্ঞরা তাদের সহায়তা দিচ্ছেন। প্রথম ধাপেই টাস্কফোর্স জালে তুলেছে বেশকিছু ‘রুই-কাতলা’। এক ডজন নামকরা শিল্প গ্রুপ ও সাবেক একজন মন্ত্রীর অর্থ পাচারের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে।


যদিও ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার টানা ১৫ বছরের শাসনামলে সব মিলিয়ে কত টাকা পাচার হয়েছে, এর সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই সরকারি কোনো সংস্থায়। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।


তবে সম্প্রতি দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এক সেমিনারে তথ্য তুলে ধরে বলেছেন, আওয়ামী লীগ শাসনামলে বছরে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার করা হয়েছে। এ হিসাবে ১৫ বছরে পাচার হয়েছে ২২৫ বিলিয়ন ডলার; অর্থাৎ ২৭ লাখ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, শুধু ব্যাংক খাত থেকে গত ১৫ বছরে ১৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার; অর্থাৎ ২ লাখ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। হাসিনার ঘনিষ্ঠ ধনকুবেররা এ পাচারকাণ্ডে জড়িত। এছাড়া দেশের অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র তৈরির জন্য গঠিত কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ১৫ বছরে পাচার হয়েছে ২৩৪ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ ২৮ লাখ কোটি টাকা। রোববার প্রতিবেদনটি প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেওয়া হয়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।


জানা যায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ২৯ সেপ্টেম্বর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা সম্পদ বাংলাদেশে ফেরত আনা ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স গঠন করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে সভাপতি করে গঠিত টাস্কফোর্সের সদস্য সচিব হলেন বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) একজন প্রতিনিধি। এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়, কাস্টম গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর, এনবিআর-এর সেন্ট্রাল ইন্টিলিজেন্স সেলের (সিআইসি) একজন করে প্রতিনিধি টাস্কফোর্সের সদস্য হিসাবে কাজ করছেন।


টাস্কফোর্সের কার্যপরিধির মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ বা সম্পদ চিহ্নিত করা ও তদন্তে সংশ্লিষ্ট পক্ষকে সহযোগিতা দেওয়া, পাচারকৃত সম্পদ উদ্ধারে দায়ের করা মামলাগুলোর কার্যক্রম দ্রুত শেষ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করা ও তা দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ, বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ বাংলাদেশে ফেরত আনার উদ্যোগ গ্রহণ, জব্দ বা উদ্ধারকৃত সম্পদের ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশ, বিদেশি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ, তথ্য সংগ্রহ এবং পাচারকৃত সম্পদ উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট পক্ষের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অভ্যন্তরীণ সমন্বয় করা। টাস্কফোর্স প্রয়োজনে কোনো সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবে এবং কোনো দেশি-বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধি বা বিশেষজ্ঞকে সভায় উপস্থিত হওয়াসহ বিশেষজ্ঞ মতামত/পরামর্শ প্রদানের অনুরোধ করতে পারবে।


জানা যায়, সন্দেহভাজন মোটা অঙ্কের অর্থ পাচারকারী হিসাবে টাস্কফোর্স সদস্যরা প্রাথমিকভাবে ১০/১২টি শিল্প গ্রুপ ও একক ব্যক্তি হিসাবে সাবেক একজন মন্ত্রীকে চিহ্নিত করেছে। তালিকার আছে ব্যাংকখেকো হিসাবে আলোচিত আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার কেন্দ্রের ছায়ায় থাকা এস আলম গ্রুপ, এস আলমের আশীর্বাদপুষ্ট রাজশাহীর নাবিল গ্রুপ, শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ, ব্যাংক মালিকদের সংগঠনের পলাতক নেতা নজরুল ইসলাম মজুমদারের নাসা গ্রুপ, প্রয়াত কাজী সাহেদের জেমকন গ্রুপ, শিকদার গ্রুপ, বিদ্যুৎ খাতের সবচেয়ে বড় লোপাটকারী সামিট গ্রুপ এবং ওরিয়ন গ্রুপ। আরও কয়েকটি গ্রুপের নামও তালিকায় রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া ব্যক্তিপর্যায়ের সবচেয়ে বড় অর্থ পাচারকারী সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের নামও রয়েছে তালিকায়। বিএফআইইউ ইতোমধ্যে এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় ব্যাংক হিসাবের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দও করেছে সংস্থাটি। আর বেক্সিমকো ফার্মা ছাড়া বেক্সিমকো গ্রুপের অন্য সব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব হাইকোর্টের নির্দেশে ফ্রিজ করা হয়েছে। ব্যাংক হিসাবের তথ্য ছাড়াও বিএফআইইউ শেয়ারবাজারে কোম্পানিগুলোর লেনদেনের যাবতীয় হিসাবও সংগ্রহ করেছে।


সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা ২০১৯-এর ক্ষমতাবলে যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের লেনদেন এক মাস বা ৩০ দিন করে সাত মাস বা ২১০ দিন ফ্রিজ করে রাখতে পারে। তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করার ক্ষেত্রে এসব আইনের ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে বিএফআইইউ। সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, দেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় লোপাটকারী এস আলমের পরিবারের সদস্যদের নামে ৩৫০টি ব্যাংক হিসাবের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব হিসাবে বিপুল টাকা লেনদেনের তথ্য রয়েছে।


জানা যায়, বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার শেয়ারবাজারখেকো হিসাবে বহুল আলোচিত সালমান এফ রহমান, নাসা গ্রুপের কর্ণধার নজরুল ইসলাম মজুমদার ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের বিরুদ্ধে দুবাই, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে বিপুল অর্থ পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। অর্থ পাচার করে এ তিনজনই নামে-বেনামে যুক্তরোজ্যে একাধিক বাড়ি কিনেছেন। সালমান এফ রহমানের কেনা একটি বাড়িতে শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানা বসবাস করতেন বলেও নিশ্চিত হয়েছে টাস্কফোর্স। সিঙ্গাপুরেও সালমান পরিবারের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিপুল সম্পদ রয়েছে। আর যুক্তরাজ্যে সাবেক ভূমিমন্ত্রীর আবাসন ব্যবসা খাতে অঢেল বিনিয়োগের সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। কোন চ্যানেলে তিনি অর্থ পাচার করে সেখানে সম্পদ গড়েছেন, তাও নিশ্চিত হয়েছে বিএফআইইউ। এছাড়া সিঙ্গাপুরে বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছে এস আলম পরিবার। সেখানে হোটেল ও পর্যটন খাতে এস আলম পরিবারের বিনিয়োগ রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ব্যাংক লুট করে সিঙ্গাপুরে বিপুল অর্থ পাচারের সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে টাস্কফোর্স।


জানা যায়, ইতোমধ্যে বিএফআইইউ-এর দেওয়া তথ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছে দুদক। টাস্কফোর্সের অন্যতম প্রতিনিধি হিসাবে দুদক তালিকায় থাকা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পাচার করা সম্পদের তথ্য-উপাত্ত কাগজে-কলমে প্রমাণযোগ্য করার পরই মামলা করবে সংস্থাটি।


ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় কাঠামো ব্যবহার করে সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীরা ব্যাংক খাত ও বাণিজ্যের আড়ালে প্রতিবছর ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছে। যে দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে, সেই দেশের সঙ্গে আইনি চুক্তি ও সমঝোতার মাধ্যমে ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব হলেও প্রক্রিয়াটি খুবই জটিল।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোয় পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বৈঠক করেছে সরকার। দুই বছরের মধ্যে যদি কোনো টাকা ফেরত আসে, তাহলে সেটাও বড় অর্জন হবে।’ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত একটি দৃষ্টান্ত আছে। ২০০৭ সালে পাচার হওয়া অর্থ ফেরতের উদ্যোগ নেয় দুদক। পারস্পরিক আইনি সহায়তার মাধ্যমে ২০১৩ সালে সিঙ্গাপুর থেকে ৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ৯৩০ কোটি ডলার ফেরত আনা সম্ভব হয়েছিল।


সংশ্লিষ্টরা জানান, অর্থ পাচার বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস এবং বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) পরিষ্কার পথনকশা আছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে দেশ থেকে প্রতিনিয়ত লাখ লাখ ডলার পাচার হয়েছে। পাচার করা এসব অর্থ ফেরানের উদ্যোগ দূরে থাক, পাচার বন্ধে কোনো সংস্থাই কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার টাস্কফোর্স গঠন করে পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে জোরেশোরে কাজ করছে।


শেয়ার করুন