০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ১১:১৫:২৪ অপরাহ্ন
এলডিডিপি প্রকল্প: খামারির প্রকল্পে সুবিধার ক্রিম খাচ্ছে কারা
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৯-০৮-২০২৩
এলডিডিপি প্রকল্প: খামারির প্রকল্পে সুবিধার ক্রিম খাচ্ছে কারা

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন (এলডিডিপি) প্রকল্পের মেয়াদ আছে আর চার মাস। অথচ প্রকল্পের বাস্তবায়ন মাত্র ৪৭ শতাংশ। এই অবস্থায় প্রকল্পের মেয়াদ আরও ২২ মাস বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। এদিকে বাস্তবায়িত হওয়া অংশ নিয়েই নানা অভিযোগ উঠেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডির নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনেও এই প্রকল্পের কিছু সমস্যা উঠে এসেছে।


জানা গেছে, প্রকল্পের জন্য কেনা ভ্রাম্যমাণ ভেটেরিনারি ক্লিনিক, ক্রিম সেপারেটর মেশিন ও আলট্রাসনোগ্রাফি মেশিন খামারিদের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে না। খামারি নয়, এমন ব্যক্তিকেও ডেমো (নমুনা) খামার বরাদ্দ দেওয়ার, অনুদানের জন্য টাকা আদায়সহ বিভিন্ন অভিযোগ করেছেন খামারিরা।


এলডিডিপি প্রকল্পের পরিচালক মো. আব্দুর রহিম এসব অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা জানান। তবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মো. এমদাদুল হক তালুকদার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব। প্রকল্পের ভালো-মন্দ দেখা ডিজি হিসেবে আমার দায়িত্ব।’


দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে এলডিডিপি প্রকল্প নেয় সরকার। এর উদ্দেশ্য, খামারি পর্যায়ে বিদ্যমান প্রতিটি গবাদিপশুর উৎপাদনশীলতা ২০ শতাংশ বৃদ্ধি করা। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে এই প্রকল্প শুরু হয়। তিন পার্বত্য জেলা ছাড়া ৬১টি জেলার ৪৬৫ উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। বলা হচ্ছে, ১ লাখ ৯০ হাজার খামারি প্রকল্পের সুফল পাবে। প্রকল্পটির মেয়াদ ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ২৮০ কোটি ৩৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক সহায়তা দিচ্ছে প্রায় ৩ হাজার ৮৮৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, করোনা-পরবর্তী সময়ে জরুরি কর্মপরিকল্পনার আওতায় খামারিদের মধ্যে ৬৫০ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এতে অনিয়ম হয়েছে। খামারিদের অভিযোগ, খামারি নয়, এমন অনেক ব্যক্তি টাকা পেয়েছেন। আবার প্রকৃত খামারিদের বড় অংশ টাকা পায়নি। ভ্রাম্যমাণ ভেটেরিনারি ক্লিনিকের ৩৬০ জন চালক নিয়োগ দেওয়া হলেও কারও কারও লাইসেন্স নেই। মনিটরিং অফিসার নিয়োগেও প্রকল্প প্রস্তাবনার (ডিপিপি) নিয়ম মানা হয়নি।


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এলডিডিপি প্রকল্পের ডেমো (নমুনা) খামার পেয়েছেন পটুয়াখালী সদর উপজেলার দক্ষিণ কালিকাপুরের সেলিম মৃধা। অথচ তাঁর জায়গা থাকলেও কোনো গরু নেই। এই মডেল খামারির খামার করার অভিজ্ঞতাও নেই। তাঁর ওই খালি জায়গায় যে গরুগুলো আছে, সেগুলো প্রতিবেশী খোকন মল্লিকের। সেলিম মৃধা আজকের পত্রিকাকে বলেন, তাঁর খামার ফাঁকা থাকায় খোকন মল্লিকের গরু রাখা হয়েছে।


পটুয়াখালী ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও এনএল ডেইরি ক্যাসেলের মালিক কামাল হোসেন অভিযোগ করে বলেন, ডেমো খামার দেওয়া সেলিম মৃধার গরুর কোনো খামার নেই। দক্ষ লোক না থাকার অজুহাতে পশু চিকিৎসা যন্ত্র পড়ে আছে উপজেলা কার্যালয়ে। কোনো কাজে লাগছে না। প্রশিক্ষণের আওতায় আনা ব্যক্তিদের বড় অংশই খামারি নন।


জানতে চাইলে পটুয়াখালী সদর উপজেলার ভেটেরিনারি সার্জন ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. জেরিন সুলতানা তৃষা বলেন, ‘কর্মকর্তারা সরেজমিনে গিয়ে যাচাই করে ডেমো খামার দিয়েছেন। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে পুনরায় যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’


গত ৩০ জুন প্রকাশিত পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডির নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪ বছর ৪ মাসে এলডিডিপি প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ৪৭ শতাংশ। অবশিষ্ট সময়ে প্রকল্পের কাজ সম্পন্নে ঝুঁকি রয়েছে। মাঠপর্যায়ে দেওয়া যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রশিক্ষণের অভাবে বা অন্য কোনো কারণে মোড়কজাত অবস্থায় পড়ে আছে। দামি এসব যন্ত্রপাতি দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকলে কর্মক্ষমতা লোপ বা নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। প্রডিউসার গ্রুপের (পিজি) আওতায় প্রকৃত খামারি নির্বাচন করা না হলে পিজির স্থায়িত্বকরণ ঝুঁকিতে পড়বে।


জানা যায়, খামার আধুনিকায়ন ব্যয়ের ৪০ শতাংশ অনুদান হিসেবে প্রকল্প থেকে দেওয়া হয়। তবে এই অনুদান পেতে ধাপে ধাপে টাকা দিতে হয় বলে অভিযোগ করেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বগুড়ার এক খামারি। তিনি বলেন, ৮৩ লাখ টাকা অনুদান পেতে তিনি ইতিমধ্যে দুই ধাপে ৮০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছেন। রংপুর অঞ্চলের আরেক খামারি বলেন, অনুদানের টাকার জন্য প্রথমে আবেদন ফরম পূরণের জন্য ২০ হাজার টাকা এবং পরে বিজনেস প্ল্যান দেওয়ার সময় ৩০ হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর মো. গোলাম রব্বানীর কথা বলে। প্রকল্পের প্রশিক্ষক রেদয়ানোর রহমান এই টাকা নেন।


তবে রেদয়ানোর রহমান বলেন, কারও নাম করে নয়, ২৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকার অনুদানের ফরম পূরণ ও বিজনেস প্রপোজাল তৈরির জন্য ফি বাবদ টাকা নিয়েছেন। অনেকে ১৫ হাজার, কেউ ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন। এর সঙ্গে ঘুষের সম্পর্ক নেই।


জামালপুরের স্বদেশ অ্যাগ্রোর মালিক হামিদ সরকার বলেন, ‘অনুদানের জন্য আমাকে চূড়ান্ত করা হলেও ঘুষ না দেওয়ায় অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছে।’


তবে এলডিডিপি প্রকল্পের চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর মো. গোলাম রব্বানী বলেন, ‘খামারিদের তথ্য ও ঠিকানা যাচাই করে অনুদান দেওয়া হয়। যারা প্রকল্পের কর্মকর্তাদের নাম বলে টাকা নেয়, তাদের আমরা চিনি না।’


জানা গেছে, উপজেলা পর্যায়ে খামারে গিয়ে অসুস্থ পশুর চিকিৎসা দিতে ২০০ কোটি টাকা দিয়ে এই প্রকল্পের আওতায় ৩৬০টি গাড়ি কিনে ভ্রাম্যমাণ ভেটেরিনারি ক্লিনিক করা হয়েছে। কিন্তু খামারিদের অভিযোগ, এসব ক্লিনিক খামারে যায় না। বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি ও সাদেক অ্যাগ্রোর মালিক মো. ইমরান হোসেন বলেন, ‘আমি ডেকেও ভ্রাম্যমাণ ভেটেরিনারি ক্লিনিকের সেবা পাইনি। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তাদের উন্নয়ন। দুধ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত সারা দেশের ১৭ লাখ খামারির কোনো কাজে আসছে না।’


ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতিতে উদ্দেশ্য সঠিকভাবে অর্জিত হয় না, অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ে। অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।


শেয়ার করুন