১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, মঙ্গলবার, ০৭:১৩:২৬ পূর্বাহ্ন
ফুটবল একাডেমির নামে দেওয়া ফিফার অনুদান আত্মসাৎ
  • আপডেট করা হয়েছে : ১০-০২-২০২৫
ফুটবল একাডেমির নামে দেওয়া ফিফার অনুদান আত্মসাৎ

একাডেমির নামে ফিফার অনুদানের সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে আত্মসাৎ করা হয়েছিল। আর এই সিন্ডিকেটের মূলহোতা ছিলেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সাবেক সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন ও বর্তমান কমিটির সদস্য মাহফুজা আক্তার কিরন। চাঞ্চল্যকর এই তথ্য পাওয়া গেছে ফিফার কাছে পাঠানো বাফুফের হিসাব বিবরণী থেকে। যুগান্তরের কাছে আলোচিত সেই হিসাব বিবরণী ফাঁস করে দিয়েছেন বাফুফেরই সাবেক এক বেতনভোগী কর্মকর্তা।


২০১১ সালে মাসিক ৫০ হাজার টাকা ভাড়ায় পাঁচ বছরের জন্য সিলেট বিকেএসপি লিজ নিয়েছিল বাফুফে। লিজ নেওয়ার পর ভাড়ার একটি টাকাও দেয়নি তারা। সেই হিসাবে প্রায় ৩০ লাখ টাকা পাবে সিলেট বিকেএসপি। ২০১৩ সালে প্রায় দুই কোটি টাকা খরচ করে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সিলেট বিকেএসপির ফুটবল একাডেমির সংস্কার করে দিয়েছিল। কোচ ও খেলোয়াড়দের জন্য আসবাবপত্র, মাঠের জন্য রোলার মেশিন, ঘাস কাটার মেশিন, জিমনেশিয়াম, ইকুইপমেন্ট, খেলার মাঠ উন্নয়ন, নতুন ড্রেন নির্মাণ, অবকাঠামো সংস্কার, মেরামতসহ পুরো ক্যাম্পাস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয়েছিল।


চারটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ক্রীড়া পরিষদ কাজগুলো করিয়েছিল। প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল-মেসার্স আলমগীর খান, মেসার্স এইচ আনিচ অ্যান্ড কোং, মেসার্স রফিক কনস্ট্রাকশন কোং এবং মেসার্স মনির কনস্ট্রাকশন। এসব প্রতিষ্ঠানের কাজের বিল ক্রীড়া পরিষদ পরিশোধ করে। বাফুফের একটি টাকাও ওই খাতে খরচ হয়নি।


২০১২ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে বাফুফের ফুটবল একাডেমির জন্য সাত লাখ মার্কিন ডলার অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন ফিফার তৎকালীন সভাপতি সেপ ব্লাটার (পরবর্তীতে আর্থিক কেলেঙ্কারির জন্য নিষিদ্ধ হন)। প্রথম দফায় চার লাখ এবং পরে তিন লাখ ডলার পাঠিয়েছিল ফিফা। সেই সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার ফিফা অনুদান একাডেমির জন্য খরচ হয়নি। কিন্তু একাডেমির খাতে খরচ দেখিয়ে ফিফার কাছে বিবরণী পাঠিয়ে পুরো অর্থ আত্মসাৎ করেছিলেন সালাউদ্দিন-কিরনরা।


২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর সিলেট ফুটবল একাডেমি চালু করেছিল বাফুফে। সেই সময়ের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মোহিত ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা তোফায়েল আহমেদকে নিয়ে একাডেমি ঘটা করেই উদ্বোধন করানো হয়েছিল। ১০ মাসের মাথায় একাডেমিটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। একাডেমির জন্য ডাচ কোচ রেনে কোস্টার ও স্প্যানিশ মরেনোকে নিয়োগ দিয়েও তাদের কাজে লাগানো হয়নি। রেনে কোস্টার জাতীয় দলের সঙ্গে বছরখানেক কাজ করে পাওনা বকেয়া থাকায় দেশে ফিরে যান। ফিফার কাছে নালিশ করে বাফুফেকে জরিমানা করিয়েছেন।


অন্যদিকে মরেনোর কোনো ধরনের কোচিং অভিজ্ঞতা না থাকার পরও কাজী সালাউদ্দিনের মেয়ের হস্তক্ষেপে বাফুফের কোচ হয়েছিলেন। তার বেতন-ভাতা দেওয়ার কথা ছিল সালাউদ্দিনের মালিকানাধীন এসএস স্টিল মিলের। পরবর্তীতে একাডেমি নয়, কয়েক মাস জাতীয় দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মরেনো। শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশ বিধ্বস্ত হওয়ায় মরেনো রাতের আঁধারে পালিয়ে যান। তার আর হদিস পাওয়া যায়নি।


ফিফার দেওয়া সাত লাখ ডলার বাফুফের কোনো বছরের অডিট রিপোর্টে দেখানো হয়নি। তবে ফিফার কাছে বাফুফ একাডেমির যে হিসাব বিবরণী পাঠিয়েছে, তার পুরোটাই ছিল ভুয়া। জালিয়াতি করে সাত লাখ ডলার হাপিস করে দেওয়া হয়। বিবরণীতে বাফুফে লিখেছে, ৬০ জন খেলোয়াড়, ১০ জন কর্মচারী, দুজন বিদেশি কোচ ও ছয়জন স্থানীয় কোচ নিয়ে একাডেমি চালু করা হয়েছে। তাদের পেছনে বছরে খরচ হচ্ছে সাড়ে সাত কোটি টাকা। তার মধ্যে ফিফার দেওয়া সাড়ে পাঁচ কোটির সঙ্গে বাফুফে খরচ করেছে দুই কোটি টাকা।


বিবরণীতে দেখানো হয়েছে, ৬০ জন খেলোয়াড় ও ১০ জন কর্মচারী ও কোচদের এক বছরের খাবার খরচ এক কোটি ২৬ লাখ টাকা। বিদেশি প্রধান কোচের বেতন মাসিক ১২ লাখ টাকা করে বছরে ১ কোটি ৪৪ লাখ। বিদেশি সহকারী কোচের বেতন ৭২ লাখ। ছয়জন স্থানীয় কোচের বেতন ৭২ লাখ টাকা। একাডেমির স্টাফ খরচ ৪৭ লাখ টাকা। খেলোয়াড়দের বেতন মাসিক পাঁচ হাজার করে ৬০ জনের ৩৬ লাখ টাকা। জার্সি-বুট ৩৩ লাখ টাকা। ফুটবল ক্রয় ১৬ লাখ টাকা। বিদেশি দলের সঙ্গে একাডেমি মাঠে তিনটি প্রীতি ম্যাচ খেলার খরচ ১৯ লাখ টাকা দেখানো হয়। এছাড়া বিদেশে তিনটি প্রীতি ম্যাচের খরচ ৬০ লাখ টাকা। আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ ৯০ লাখ। ইউটিলিটি খাতে ১৫ লাখ।


শুধু একাডেমির নামেই অর্থ আত্মসাৎ নয়, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আত্মীয়করণ, অনিয়ম আর কমিশন বাণিজ্যে মাতোয়ারা ছিলেন কাজী সালাউদ্দিন ও কিরন গংরা। যুবলীগের সাবেক মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা কিরন বাফুফেকে ব্যবসাকেন্দ্র বানিয়ে ফেলেছিলেন। আর্থিক অনিয়মের কারণে বাফুফের বেতনভোগী সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগকে চার বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল ফিফা। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদীকে প্রায় ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে ফিফা।


শেয়ার করুন