ঢাকার সরকারি সাত কলেজকে নিয়ে যে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হতে যাচ্ছে, তার নাম হবে ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি (ডিসিইউ)। গতকাল রবিবার বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অডিটরিয়ামে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের ৩২ সদস্যের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজসহ অন্যদের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এই নাম চূড়ান্ত হয়। তবে এর কার্যক্রম শুরু হতে বেশ সময় লাগবে। এজন্য আগামী ২০৩১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তাই নাম চূড়ান্ত হলেও ২০৩১ সাল পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) অধীনে স্বতন্ত্র নজরদারি সংস্থা কাঠামো থেকে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে সাত কলেজ। এদিকে ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির মূল ক্যাম্পাস কোথায় হবে, সেটি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। জানা গেছে, তিতুমীর কলেজে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস হতে পারে। প্রসঙ্গত, বর্তমানে এই সাত কলেজে শিক্ষার্থী প্রায় ২ লাখ। শিক্ষক ১ হাজারের বেশি।
সূত্র জানায়, বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির কার্যক্রমের পরিকল্পনা করা হচ্ছে কলেজগুলোর ঐতিহ্যকে ধারণ করেই। বিশ্ববিদ্যালয়টি শুধুমাত্র কলেজগুলোর সময় ও জায়গা শেয়ার করবে। সাত কলেজের যে পাঁচটিতে ইন্টারমিডিয়েট শিক্ষার্থী ছিল সেটি তেমনই থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়টি শুধু কলেজের সময় ও জায়গা শেয়ার করবে। এতে ইন্টারমিডিয়েট শিক্ষার্থী ও উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষকদের অবস্থান একই থাকবে। তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী এটি হবে নতুন মডেলের বিশ্ববিদ্যালয়। যা নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একাধিক শিক্ষক কাজ করছেন বলেও জানা গেছে। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) বৈঠক পূর্বনির্ধারিত ছিল। রবিবার সকাল থেকেই দলে দলে শিক্ষার্থীদের আগমন ঘটে। গোলটেবিল বৈঠকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শুরু হয় আলোচনা। ইউজিসি চেয়ারম্যান, সদস্যসচিব ও কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এরপরই বেশিসংখ্যক প্রার্থীর সুপারিশের ভিত্তিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সম্মতি দেওয়া হয়। তবে কিছু শিক্ষার্থীর অভিযোগ, সাত কলেজ হওয়ায় বিভিন্ন ধরনের নামই প্রস্তাব করা হয়েছে। নাম নির্ধারণে যেন কোনো সমস্যা না হয় এজন্য তালিকাভুক্ত করে শিক্ষার্থীদের ইনভাইটেশন দেওয়া হয়েছে। তবে তিতুমীরের শিক্ষার্থীদের এই নামে কোনো ধরনের আপত্তি নেই বলে একাধিক শিক্ষার্থী নিশ্চিত করেন। তবে নতুন নামকরণ নিয়ে শিক্ষার্থীরা আনন্দে স্লোগানে ইউজিসি ভবনে শোরগোল তোলেন। তাদের নতুন পরিচয় ডিএসইউ নিয়েও মাতামাতি করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ গতকাল বিকালে ইত্তেফাককে বলেন, ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি সরকারের অনুমোদনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম দ্রুত শুরু করার সব ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও সার্বিক সহযোগিতা পাচ্ছি। সব উদ্যোগের সঙ্গে সাত কলেজের শিক্ষার্থী প্রতিনিধিরা রয়েছেন। তাদের সঙ্গে নিয়ে কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।’ এদিকে ইউজিসির উপপরিচালক (পাবলিক ইউনিভার্সিটি) জামাল উদ্দিন গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ইউজিসির চেয়ারম্যান গতকাল সকালে সাত কলেজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসেছিলেন। সেখানে তিনি সাত কলেজের সমন্বয়ে গঠিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ ঘোষণা করেন। কবে থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাত্র তো নাম ঠিক হলো। এখন আইন নিয়ে কাজ করতে হবে। এরপর সংসদে এ আইন পাশ করে তবেই বিশ্ববিদ্যালয়। পুরো শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করতে ২০৩১ সাল পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
ঢাবির সিন্ডিকেট অনুমোদন দিলেই অন্তর্বর্তী প্রশাসনের কাঠামো চূড়ান্ত হবে :এদিকে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বলেন, সরকারি সাত কলেজকে নিয়ে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হবে ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি (ডিসিইউ)। এই নামটি চূড়ান্ত করার আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ইমেলের মাধ্যমে বিভিন্ন অংশীজনদের মতামত নিয়েছে। পাশাপাশি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে ২৮টি টিম গঠন করা হয়েছে। এই ২৮টি টিম নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে মতামত দিয়েছে। গতকাল ইউজিসিতে এই ২৮টি টিমের লিডারদের সঙ্গে বসে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। রবিবার ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টার আসন্ন চীন সফর নিয়ে কথা বলার সময় আজাদ মজুমদার সাত কলেজ নিয়ে আরও বলেন, ‘এই প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তী প্রশাসনের কাঠামো হবে, সেটার একটি রূপরেখা তৈরি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট অনুমোদন করলে অন্তর্বর্তী প্রশাসনের যে কাঠামো সেটি চূড়ান্ত হয়ে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য একজন অন্তর্বর্তী প্রশাসক থাকবেন। এই সাত কলেজের যারা অধ্যক্ষ রয়েছেন, তাদের মধ্য থেকেই একজন হবেন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্বর্তী প্রশাসক। যিনি মনোনীত হবেন, তার কলেজটাই হবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস।’
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ গত জানুয়ারিতে বলেছিলেন, সাত কলেজের জন্য পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হতে পারে ‘জুলাই ৩৬ বিশ্ববিদ্যালয়’। তবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার পর ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ নামটি চূড়ান্ত হলো। সাত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপান্তর আন্দোলন টিমের ফোকাল পয়েন্ট ও ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান বলেন, ‘সাত কলেজকে নিয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয় হতে যাচ্ছে, সেটির নাম ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি বা ডিসিইউ হতে যাচ্ছে। মোট ৪০টি নাম প্রস্তাব করা হয়েছিল, সেখান থেকে দুটি নামে আসে। শিক্ষার্থীদের একটি অংশ ঢাকা ফেডারেল ইউনিভার্সিটি নামকরণের পক্ষে মত দিয়েছিল। কিন্তু পরে উভয় পক্ষের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি নামটিই চূড়ান্ত করা হয়েছে।’
ঢাকার সরকারি সাত কলেজ হলো ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। এসব কলেজে শিক্ষার্থী প্রায় ২ লাখ। একসময় দেশের সব ডিগ্রি কলেজ পরিচালিত হতো ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। ১৯৯২ সালে সরকারি কলেজগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। ২০১৪ সালের শেষ দিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ২৭৯টি সরকারি কলেজকে বিভাগীয় পর্যায়ের পুরোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর ধারাবাহিতায় ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সাত সরকারি কলেজকে ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়া হয়। ক্ষমতার পালাবদলের পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সাত সরকারি কলেজকে অধিভুক্তি থেকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এর অংশ হিসেবে ২০২৪-২৫ সেশন, অর্থাৎ চলতি বছর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সাত কলেজের শিক্ষার্থী ভর্তির কার্যক্রম বন্ধ করার কথা জানানো হয় গত ২৭ জানুয়ারি। তার আগেই গত ডিসেম্বরে সাত কলেজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকক্ষ একটি স্বতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর রূপরেখা প্রণয়নে চার সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি করা হয়। ঐ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে একটি নজরদারি সংস্থা কাঠামো করার প্রস্তাব দেয়, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ঐ প্রস্তাব অনুযায়ী, ঢাকার সরকারি সাত কলেজ পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় বা সমকক্ষ হওয়ার আগ পর্যন্ত একজন অধ্যক্ষের নেতৃত্বে সার্বিক কার্যক্রম পরিচালিত হবে আর পুরো কার্যক্রমের ওপর নজরদারি করবেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) একজন সদস্য।