রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির আলোচনায় কালক্ষেপণের অভিযোগ করেছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি। ইউক্রেনে দ্রুত একটি যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন কয়েক সপ্তাহ ধরে যে চেষ্টা চালিয়ে আসছে, তাতে দ্রুতই রাশিয়া সাড়া দিক এমন দাবি উঠেছে। এদিকে ইউক্রেনে জেলেনস্কির নিজ শহরে রুশ বাহিনীর ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ৯ শিশুসহ ১৮ জন নিহত হয়েছে।
শুক্রবার (৪ এপ্রিল) বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে পশ্চিমা সামরিক জোট নেটোর পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে ব্রিটিশ, ফরাসি ও জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ঐ অভিযোগ করেন। মার্চ মাসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। কিয়েভ এতে সম্মতি জানিয়েছিল। তবে পুতিন পুরো ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতিতে রাজি হননি। কেবল জ্বালানি অবকাঠামোতে হামলা বন্ধে সম্মতি জানান তিনি। কিন্তু পরে ইউক্রেন তা লঙ্ঘনের অভিযোগ করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। আবার রাশিয়াও পালটা অভিযোগ করে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি পুতিনের সরকারি বাসভবন ক্রেমলিনের এক কর্মকর্তা বলেন, রাশিয়া ইউক্রেনে তাদের তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধ শেষ করার চেষ্টাকে একটা 'লম্বা প্রক্রিয়া' হিসেবেই দেখে। শুক্রবার ন্যাটো সদরদপ্তরে ফ্রান্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি সাংবাদিকদেরকে বলেন, পুতিন বিভ্রান্তি অব্যাহত রেখেছেন, সময়ক্ষেপণ করে যাচ্ছেন। তিনি এখন যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি ইউক্রেনে সাধারণ মানুষ এবং জ্বালানি স্থাপনায় বোমা হামলা চালিয়ে যাচ্ছেন। আপনি কী করছেন তা আমরা জানি। ওদিকে, জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পুতিনের শান্তিচুক্তি আলোচনা অন্তঃসারশূন্য প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছুই নয়। নতুন নতুন দাবি তুলে তিনি কালক্ষেপণ করছেন। কানাডা ও এস্তোনিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরাসহ আরো অনেকেই রাশিয়ার জন্য যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মেনে নেওয়ার একটি সময়সীমা ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার কাছ থেকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সইয়ে তাদের আন্তরিক থাকার প্রমাণ দাবি করুক, এমনটিই চাইছে ইউরোপীয় মিত্রদেশগুলো। আর এই প্রেক্ষাপটেই কোনো কোনো দেশ যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মেনে নেওয়ার জন্য রাশিয়াকে সময় বেঁধে দেওয়ার কথা বলছে। ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মস্কোকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জবাব দিতে হবে। তারা (যুক্তরাষ্ট্র) কঠোর পরিশ্রম করেছে। মধ্যস্থতার চেষ্টা নিয়ে এগিয়ে গেছে এবং একটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব দিয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার জন্য রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়াতে একটি সময়সীমা ঘোষণার বিষয়ে কোনো মতৈক্য হয়নি। তবে যুদ্ধবিরতি যত তাড়াতাড়ি হয়, ততই ভালো-এটি সবাই স্বীকার করেছে। সবাই এ বিষয়ে একমত হয়েছে যে, রাশিয়ার আরো বেশি কিছু করা দরকার। রাশিয়ার যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, রাশিয়া ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক কি না, তা যুক্তরাষ্ট্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই জেনে যাবে। তিনি বলেন, 'আমি আশা করি তারা (রাশিয়া) আন্তরিক। আর যদি এটা কালক্ষেপণ হয়, তাহলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অন্তহীন আলোচনার ফাঁদে পা দেবেন না। রাশিয়া শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী কিনা, তা দেখতে আমরা তাদেরকে পরীক্ষা করছি। তাদের কাজ দেখছি। কথা নয়। তাদের কাজই বলে দেবে তারা সিরিয়াস কি না। কয়েকটি সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে রাশিয়ার অভিপ্রায় নিয়ে হোয়াইট হাউজ উদ্বিগ্ন। যদিও ট্রাম্প প্রকাশ্যে এ কথাই বলে আসছেন যে, পুতিন যুদ্ধ শেষ করতে চান বলেই তিনি বিশ্বাস করেন।
এদিকে ইউক্রেনের মধ্যাঞ্চলীয় শহর ক্রিভি রি-তে শুক্রবার দিনভর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় রুশ বাহিনী। এতে নিহত হয়েছে ১৮ জন এবং আহত হয়েছে অন্তত ৫০ জন। নিহতদের মধ্যে ৯ জনই শিশু/অপ্রাপ্তবয়স্ক। ক্রিভি রি শহরটি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলাদিমির জেলেনস্কির হোমটাউন হিসেবে পরিচিত। জেলেনস্কির জন্ম ও বেড়ে ওঠা এ শহরেই। ইউক্রেনের মানবাধিকার বিষয়ক সর্বোচ্চ কর্মকর্তা দিমিত্রো লুবিনেটস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে জানান, শুক্রবার ক্রিভি রি শহরের হামলায় বেশ কয়েক ডজন ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে রুশ বাহিনী। ব্যবহৃত ক্ষেপণাস্ত্রগুলো অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে নিখুঁতভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম এবং উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা সিস্টেম ব্যতীত এগুলোকে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার আগে ধ্বংস করা প্রায় অসম্ভব। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকেও এ হামলার ব্যাপারে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে পোস্ট করা সেই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, রাশিয়ার সেনা কর্মকর্তা, সদস্য ও বিদেশে সেনা প্রশিক্ষকদের লক্ষ্য করে এ হামলা চালানো হয়েছিল। বিবৃতিতে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, শুক্রবারের হামলায় ৮৫ জনেরও বেশি ইউক্রেনীয় সেনাসদস্য-কর্মকর্তা-বিদেশি প্রশিক্ষক নিহত হয়েছেন এবং ২০টিরও বেশি যানবাহন ধ্বংস হয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলাদিমির জেলেনস্কি জানান, ক্রিভি রি-তে এখন জঞ্জাল পরিষ্কার ও ধ্বংসস্তূপে আটকে পড়াদের উদ্ধার কাজ চলছে। পুরো বিশ্ব ইউক্রেনের পরিস্থিতি দেখছে। রুশ বাহিনীর নিক্ষেপ করা প্রতিটি ক্ষেপণাস্ত্র, প্রতিটি ড্রোন প্রমাণ করে যে রাশিয়া কেবল যুদ্ধই চায়, টেলিগ্রামে পোস্ট করা এক বার্তায় বলেন জেলেনস্কি।