সময়ের পীঠে এপিটাফ রেখে কালের যাত্রায় বড় দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে দিনক্ষণ। কোটা সংস্কারের টানা ৩৬ দিনের সংশপ্তক আন্দোলন থেকে দুনিয়া কাঁপানো অভাবনীয় অবিনাশী গণঅভ্যুত্থানে রূপ পরিগ্রহ করা যে রক্তাক্ত জুলাই বদলে দিয়েছে এই ভূখণ্ডের ইতিহাস-স্রোতধারা; তার পয়লা বর্ষপূর্তি আজ। আওয়ামী লীগের দীর্ঘ স্বৈরাচারী উৎপীড়ন গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি রচনা করেছিল। এই অভ্যুত্থানে সারা দেশের নাগরিক শক্তির এক অভূতপূর্ব ও দুঃসাহসী ঐক্য গড়ে ওঠে, যা চেপে বসা শেখ হাসিনার দীর্ঘ দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী নাগপাশকে উৎখাত করে।
গত বছরের জুলাই মাসটা যেন ইতিহাসের পৃষ্ঠায় উৎকীর্ণ এক দাবানল বিস্ফোরিত অগ্নিময় অধ্যায়। জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল বাংলাদেশের মানুষের আত্মপরিচয়, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ১৬ বছরের সংগ্রামের মাইলফলক। নিকশ ফ্যাসিবাদ পতনের গহিন থেকে উদীত হয় এক নতুন সূর্যের। আজ শুধু একটি জগদ্দল সরকারের পতনের বার্ষিকী নয়, বরং একটি জাতির গণতান্ত্রিক চেতনার পুনর্জাগরণের স্মরণীয় দিন। এ গণঅভ্যুত্থান ছিল সময়ের দাবি ও অনিবার্য এক রাজনৈতিক বিস্ফোরণ। কার্যত এই গণঅভ্যুত্থান দীর্ঘ জুলুমের পাটাতনের ওপর স্থাপিত হয়েছিল অনেক আগেই। যখন মানুষের সব অধিকার হরণ করে নিয়েছিল আওয়ামী সরকার। তারা মানুষের স্বপ্ন লুট করে নিয়েছিল, বাজেয়াপ্ত করেছিল কণ্ঠ, ঘরে ঘরে ক্রন্দন, নিঃসঙ্গ নীরব অশ্রুপাতে ভারী হয়ে উঠেছিল আসমান-জমিন। একের পর এক গণআন্দোলন দমন, গুম, খুন, হামলা-মামলা, আয়নাঘর, অলিগার্কদের লুটপাট স্বেচ্ছাচারিতার মোচ্ছব মানুষের মনে দাগ কেটেছে। সর্বোপরি ভোটাধিকার দলিত করা হয়েছিল বীভৎস নির্মমতায়। মানুষ হারিয়ে ফেলেছিল বিশ্বাস, হারিয়ে নাগরিকত্বের আত্মবিশ্বাস।
দীর্ঘ জুলুমের ইতিহাস থেকে মানুষের মনে যে ক্ষত এবং বারুদ ভরা দ্রোহের জন্ম নিয়েছিল, সেখান থেকে হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে জুলাইয়ে অনেকে পথে নেমেছিলেন। জুলাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল জুলুমবাজ আওয়ামী শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়যজ্ঞের বিরুদ্ধে বুক টান করে দাঁড়ানো অসমসাহসী ছাত্র-জনতার বীরত্বের স্মারকস্তম্ভ।
গত বছরের ১ জুলাই শিক্ষার্থীদের 'কোটা সংস্কার আন্দোলন' 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে' রূপ নেয়। এটি ছিল প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পদধ্বনি। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত 'জুলাই বিদ্রোহে' রূপ নেবে, গণহত্যার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ একত্র হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তর গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে, এটা ছিল কল্পানাতীত। সরকার প্রতিবাদকারীদের কঠোরভাবে দমন করতে চাইলে পরিস্থিতি বিদ্রোহে রূপ নেয়।
জুলাই-আগস্ট মাসের আন্দোলন শুধু একটি দাবি পূরণের সংগ্রাম ছিল না; এটি ছিল সর্বস্তরর জনসাধারণের ন্যায্য-যৌক্তিক ও মৌলমানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে এক অবিস্মরণীয় দুর্দমনীয় বৈপ্লবিক উৎক্ষেপ। স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে রংপুরের শহিদ আবু সাইদ দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে গুলিবিদ্ধ হওয়ার অসম সাহসিকতার ভেতর দিয়ে জুলাই আন্দোলনের যে দাবানল বিস্ফোরণ ঘটেছিল, তার পটভূমি ক্রমে রচিত হয়েছিল। ১/১১-এর প্রেক্ষাপটে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সামরিক ছাউনি নিয়ন্ত্রিত প্রশ্নবিদ্ধ ভোটে ক্ষমতায় এসে জোরেশোরে প্রতিহিংসাপরায়নতা, লুটপাট-দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হতে শুরু কর। নেতাকর্মীর দৌরাত্ম্য বাড়ল; আমলা-পুলিশও চাটুকারিতায় নিয়েজিত হলো। ক্ষমতাসীনদের ঘিরে সুবিধাভোগী গোষ্ঠী তৈরি হলো। সব অপকর্ম শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও বিকৃত করা হলো।
এক দল চাট্টকর শেখ হাসিনার গুণকীর্তনে মগ্ন হলেন। তাকে বলতে শুরু করলেন, আপনি বিশ্বনেত্রী। আপনার মতো নেত্রী আর কোথাও নেই। নোবেল পুরস্কার আপনারই প্রাপ্য।
এভাবেই শেখ হাসিনার জনবিচ্ছিন্নতা বাড়তে লাগল। যে গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য জানবাজি রেখে লড়াই করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান কায়েম করেছিল গোটা জাতি; তা পরিহার করে ২০১৪ সালে বিরোধী দলকে মাঠের বাইরে রেখে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্ষমতায় গেলেন হাসিনা। বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করতে গুম খুন জুডিশিয়াল কিলিংয়ে মদমত্ত হলো শাসকগোষ্ঠী। ২০১৮ সালে দিনের ভোটে রাতে করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করলেন। ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী লীগের আমি-ডামি ভোট রঙের মধ্যে ভোটখেলায় আরেক মেয়াদে ক্ষমতা দখল করলেন ফ্যাসিবাদের বিমূর্ত প্রতীকে পরিণত হওয়া শেখ হাসিনা। তারও আগে এক দীর্ঘ ষড়যন্ত্রের সূচনা সেই এক এগারোর অশুভ ঐক্যের মাধ্যমে, বিএনপি আর জিয়া পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করার দেশীয় ষড়যন্ত্রের নকশা রচিত হয়েছে আন্তর্জাতিক সহযোগীদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে অন্তরীণ, গ্রেফতার করা হয় তারেক রহমানকে। বাদ গেলেন না তার ছোট ভাই রাজনীতি থেকে হাজার মাইল দূরে থাকা আরাফাত রহমান। অমানবিক নির্যাতনে প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি গণমানুষের অভাবনীয় -ইত্তেফাক জনপ্রিয় নেতা তারেক রহমান বাধ্য হলেন দেশ ছাড়তে, শুধু চিরস্থায়ী পঙ্গুত্ব থেকে রক্ষা পেতে। তারই ধারাবাহিকতায় জিয়া পরিবারকে ২০১৮ সালের নির্বাচন কণ্টকমুক্ত করতে বেগম জিয়াকে মিথ্যা সাজানো মামলায় ফরমায়েশি রায়ে কারাগারে নিক্ষেপ করে হত্যা চেষ্টা অব্যাহত রাখে শেখ হাসিনার সরকার। বিনা সুচিকিৎসায় তাকে পঙ্গু করা হয়। আর বিএনপি ও জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলোর ওপর অকল্পনীয় নির্যাতন-উৎপীড়ন চলানো হয়।
অন্যদিকে প্রায় এই দেড় যুগকাল 'উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশ'-স্লোগানের আড়ালে রাষ্ট্রীয় অর্থসম্পদ লুটপাট ও বিদেশে অর্থপাচারই ছিল হাসিনাগংদের মূল লক্ষ্য। একদা এমপি-মন্ত্রীরা জনগণের কাছে আসতেন, তাদের কথা শুনতেন। জনগণ বলতে পারতেন, জিনিসপত্রের দাম না কমলে, ছেলেমেয়েদের চাকরি না হলে ভোটের বাক্সে জবাব দেব। শেখ হাসিনার শাসনামলে সে সুযোগ তিরোহিত হয়। নেতারা বলতেন-নৌকা মার্কা পেলেই চলবে, ভোট লাগবে না। ভোটে জিততে ভোটার লাগে না, দরকার ক্যাডার আর আমলা-পুলিশের। টানা ১৬ বছরের শাসনে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে; পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, মেট্রোরেলসহ নানা স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। তা ছাপিয়ে উঠেছে মন্ত্রী-এমপিদের বিত্তবৈভবের প্রতিযোগিতা; বেনজীর-মতিউরদের লুটপাটের কেচ্ছাকাহিনি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তার একজন পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক। কিন্তু আমজনতার আয় বাড়েনি, ব্যয় বেড়েছে। আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলছে না। দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না সাধারণ মানুষ। ভোট দিতে না পারার যন্ত্রণা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, লুটপাট, দুর্নীতি, কর্তৃত্ববাদী শাসনের ফলে জনমনে যে ক্ষোভ জমাট বেঁধেছিল, তা আছড়ে পড়েছিল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে। তারা বিস্মৃত হয়েছিলেন, অবকাঠামোগত উন্নয়নই কেবল উন্নয়ন নয়; জনগণের জীবনমানের উন্নয়নই আসল কথা। এ প্রসঙ্গে পাকিস্তান আমলের আইয়ুবের শাসনের কথা উল্লেখ করা যায়। প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। তার শাসন আমলেই রাস্তাঘাটসহ ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছিল। শহর ও গ্রামে, রাজনীতিক ও আমলাদের মধ্যে একটি সুবিধাভোগী গোষ্ঠী জন্ম নিয়েছিল। তারাই ছিল আইয়ুবের তল্পিবাহক। ১৯৬৮ সালে ঘটা করে উন্নয়ন দশক পালন করেছিল। সাধারণ মানুষের গায়ে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। তাদের কষ্টবোধ ছিল, ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছিল, কেবল বিডি মেম্বাররাই ছিল ভোটের মালিক। জনগণ উপহাস করে বলত, আইয়ুবেব ৮০ হাজার ফেরেশতা; যার মধ্যে বাংলাদেশে ছিল ৪০ হাজার। 'উন্নয়ন দশক'-এর এক বছরের মাথায় জনগণের সেই পুঞ্জীভূত ক্ষোভের আগুন জ্বলেছিল উনসত্তরের গণআন্দোলনে, যা স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের বিদায়ঘণ্টা বাজিয়েছিল। ৫৫ বছর পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। স্বাধীন বাংলাদেশে গণআন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন ঘটল আরো করুণভাবে।
একদা যাদের ভোটাধিকার কেড়েছিলেন; ন্যায়সংগত দাবি অগ্রাহ্য করেছিলেন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে উপহাস করেছিলেন। ভুলে গিয়েছিলেন সেই অমোঘ বাণী, 'বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা'। সেই জাগ্রত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান আধুনিক কালের নারী রামেসেস হাসিনা। এ আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন স্কুলছাত্র, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, মাদ্রাসাপডুয়া, শিক্ষক, নারী, শ্রমিক, পেশাজীবী ইত্যাদি নানা স্তর ও বর্গের মানুষ। বাম, ডান, মধ্যপন্থি নানা পক্ষের রাজনৈতিক দল ও তাদের সমর্থকেরা আন্দোলনে যোগ দেন। নারী, শ্রমিক এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা-সমাজে যারা নানাভাবে প্রান্তিক হয়ে থাকেন, তাদের অংশগ্রহণ ছিল অবারিত। নারীরা নানা পর্যায়ে আন্দোলনকে উজ্জীবিত রাখেন।
নিকেশে প্রমাণিত হলো দেশের মালিক জনগণ। জনগণের শক্তিই বড় শক্তি। দুই সহস্রাধিক ছাত্র-জনতার শাহাদতের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা। অথচ এই বিজয় অর্জন এতটা সহজ ছিল না, দীর্ঘ সতেরো বছর ধরে আগ্নেয়গিরির লাভা উত্তপ্ত হতে হতে মহাবিস্ফোরণে অগ্ন্যুৎপাতে উদ্গিরিত হয়েছে ২০২৪ সালের ৩৬ জুলাই, ৫ আগস্টের দ্বিপ্রহরে।