০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ১১:৫৫:৪৬ অপরাহ্ন
ধর্ষণে জন্ম নেয়া ছেলেই ধর্ষকদের দাঁড় করালো বিচারের কাঠগড়ায়
  • আপডেট করা হয়েছে : ১১-০৮-২০২২
ধর্ষণে জন্ম নেয়া ছেলেই ধর্ষকদের দাঁড় করালো বিচারের কাঠগড়ায়

শিশুকে বাড়িতে একা পেয়ে আলাদা সময়ে সীমানা প্রাচীর ডিঙিয়ে ঘরে ঢুকতো দুই ভাই। এরপর শিশুকে ধর্ষণ করতো তারা। টানা ছয় মাস দুই ভাইয়ের ধর্ষণে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ে শিশুটি। তারপর লাঞ্ছনা, বঞ্চনায় কেটে যায় ৩০ বছর। তবে ধর্ষণে জন্ম নেয়া ছেলেই ৩০ বছর পর মায়ের ধর্ষকদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে।

সংবাদমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, ৩০ বছর আগে ভারতের উত্তর প্রদেশের ১২ বছরের এক মেয়ে শিশুকে টানা ছয় মাস ধর্ষণ করেন দুই ভাই। সেই ধর্ষণের ফলে ভুক্তভোগী এক সন্তানের জন্ম দেন। সেই সন্তানকে দত্তক দিলেও ১৩ বছর বয়সে ছেলে ফিরে আসে।

তারপর ছেলের অনুপ্রেরণায় অভিযুক্ত দুই ধর্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করেন ভুক্তভোগী। মামলার ১০ দিন পরই পুলিশ বুধবার একজনকে গ্রেপ্তার করে এবং অন্যজনকে আগেই পুলিশ হেফাজতখানায় রাখা হয়েছে।

ভুক্তভোগী নারী বলেন, ঘটনাটি অনেক পুরনো। কিন্তু এটির ক্ষত এখনো শুকায়নি। ঘটনাটি আমার জীবনে স্থবির করে ফেলে। সেই নিষ্ঠুর সময় বারবার আমার মনে ভেসে উঠে।

সংবাদমাধ্যম বলছে, প্রতি বছর ভারতে শিশুদের যৌন নির্যাতনের হাজার হাজার অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে ২০২০ সালেই ভারতের শিশু নির্যাতন প্রতিরোধী আইনের অধীনে ৪৭ হাজার অভিযোগ নথিভুক্ত হয়েছে।

শিশুদের যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার সমাজকর্মীরা বলছেন, অনেক শিশু ভয়ে কিংবা অনেকে যৌন নির্যাতনের বিষয়টি বুঝতে পারেন না বলেই অভিযোগ করেন না। এমনকি অপরাধীরা প্রতাপশালী হলে পরিবারই আতঙ্কে নির্যাতনের বিষয়টি এড়িয়ে চলেন।

আমার হৃদয় আতঙ্কগ্রস্ত

উত্তর প্রদেশের ঐ ভুক্তভোগী নারী বলেন, ১৯৯৪ সালে শাহজাহানপুর শহরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। অভিযুক্ত মোহাম্মদ রাজি ও তার ভাই নাকি হাসান আমাদের প্রতিবেশী ছিল। যখন আমি বাড়িতে একা থাকতাম তখনই তারা বাড়ির প্রাচীর অতিক্রম করেই আমাকে ধর্ষণ করতো।

হঠাৎ আমার শারীরিক স্বাস্থ্য খারাপ হলে আমার বোন চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। সেখানেই আমার গর্ভধারণের বিষয়টি প্রথমে ধরা পড়ে। তখন আমার কম বয়স ও স্বাস্থ্যহানীর জন্য গর্ভপাত করা বাতিল করেন চিকিৎসক। জন্মের পরই আমার সন্তানকে দত্তক দিয়ে দেই।

তিনি আরো বলেন, আমি সন্তানটির জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছি। দত্তক দেওয়ার পর তার মুখ আমি কখনো দেখতে পাইনি। তখন আমার মা বলতেন, তুমি দ্বিতীয় জীবন পেয়েছো।

নিজের ওপর দোষ পড়বে বলে তখন পরিবার পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাননি বলেও উল্লেখ করেন ভুক্তভোগী।

ভুক্তভোগী বলেন, তখন ঘটনাটি কাউকে বললে তারা (ধর্ষকরা) আমাদের পরিবারের সদস্যদের হত্যা ও আমাদের বাড়ি পুড়িয়ে ফেলার হুমকি দিতো। আমার ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল পুলিশে যোগদান করবো। কিন্তু দুই ধর্ষকের কারণে আমার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। আমি স্কুলে যেতে পারিনি এবং লেখাপড়াও হয়নি।

পরবর্তীতে আমি ও আমার পরিবার সেই বাড়ির দুঃসহ যন্ত্রণা ভুলতে রামপুর জেলায় স্থানান্তরিত হই। ২০০০ সালে আমার বিয়ে হয় এবং আমি দ্বিতীয় সন্তানের মা হই। তখন ভাবছিলাম হয়তো জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। কিন্তু সংসার জীবনের ছয় বছরের মাথায় ধর্ষণের ঘটনাটি স্বামী জেনে যান। এজন্য তিনি আমাকে দোষারূপ করেন।

স্বামী ছেড়ে দেওয়ার পর বোন ও তার পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতে থাকেন ভুক্তভোগী।

সত্যের জন্য ছেলের যুদ্ধ

পরিচয় সংকটের জন্য ভুক্তভোগীর প্রথম সন্তান নানা বৈষম্যের মুখোমুখি হয়েছেন। তার দত্তক মা তাকে বলেছিল, তোমাকে অন্য জায়গা থেকে আনা হয়েছে এবং তুমি একটা জারজ সন্তান। তখন ভুক্তভোগীর ছেলে নিজে দত্তক হওয়ার বিষয়টি টের পান।

মা ও ছেলের ১৩ বছরের বিচ্ছেদের পর তাকে ভুক্তভোগীর কাছে ফিরিয়ে দেন দত্তক নেয়া বাবা-মা। কিন্তু ছেলে তার মায়ের কাছে বাবার পরিচয় জানতে চায়। কারণ বাবার পরিচয় হিসেবে তার সংক্ষিপ্ত নাম ছিল না। এজন্য সহপাঠীরা তাকে ক্ষেপিয়ে তুলতো। তাই বারবার মায়ের কাছে পিতৃত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে সে। কিন্তু কোনো উত্তর না পেয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে ছেলে।

ভুক্তভোগী বলেন, তারা ছেলে বাবার নাম ছাড়া বাঁচতে পারবে না বলে জানায় এবং বাবার নাম প্রকাশ না করলে আত্মহত্যার হুমকি দেয় ছেলে। প্রথমদিকে প্রশ্নের জন্য তাকে বকাঝকা করতাম। কিন্তু অবশেষে বাধ্য হয়ে সত্য বলে দিয়েছি।

ঘটনা শোনার পর আতঙ্কিত না হয়ে ছেলে মায়ের সবচেয়ে বড় সমর্থক হয়ে পড়ে। একইসঙ্গে অভিযুক্তদের শাস্তি দিতে লড়াইয়ের জন্য ছেলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।

ছেলে মাকে জানায়, যদি তোমার সঙ্গে যা ঘটেছে তা হয়তো আরো অনেকের সঙ্গে হয়েছে। আমাদের মামলা ও অভিযুক্তরা শাস্তি পেলে অন্যান্যরা ভরসা পাবে। এটি সমাজের জন্য একটি বার্তা হয়ে যাবে যে, কেউ অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকলে শাস্তি থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না।

ন্যায়বিচারের জন্য যুদ্ধ

ছেলের উৎসাহে ২০২০ সালে শাহজাহানপুরে যান ভুক্তভোগী। কিন্তু সেখানে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা করতে তিনি প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েন। অনেক দিনের পুরনো ঘটনা উল্লেখ করে মামলা নিতে চায়নি পুলিশ। পরে তিনি এক আইনজীবীর দ্বারস্ত হন। আইনজীবীও জানান, তিন দশকের আগের ঘটনা নিয়ে মামলায় লড়াই করা মুশকিল ও কষ্টকর।

ভুক্তভোগী যে বাড়িতে শিশু হিসেবে বসবাস করতেন সেটির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তিনি তার পুরনো বাড়িটিও শনাক্ত করতে পারেননি। এমনকি অভিযুক্তদের শনাক্ত করতে পারছিলেন না।

আইনজীবী ভুক্তভোগীকে প্রশ্ন করেন, আপনি তিন দশক আগে এখানে বসবাসের বিষয়টি কীভাবে প্রমাণ করবেন?, আপনি এখানেই যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে তাও কীভাবে প্রমাণ করবেন?

ভুক্তভোগী বললেন, আমি প্রমাণ আনবো, আপনি আমার মামলার ব্যবস্থা করুন। অবশেষে ২০২১ সালের মার্চে শাহজাহানপুর চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দুইজনকে অভিযুক্ত করে মামলা করা হয়।

তখন দুই অভিযুক্ত খোঁজে বের করতে ভুক্তভোগীকে আহ্বান জানায় পুলিশ। পরে আমি অভিযুক্ত দুইজনের সঙ্গে ফোনে কথা বললাম। তখন তারা আমাকে বলেছিল- তুই এখনো মরিসনি?। আমি তাদের বললাম-এখন তোমাদের মৃত্যুর সময় এসেছে।

প্রমাণ ও গ্রেপ্তার

অবশেষে অভিযুক্তদের শনাক্ত করা গেলেও তাদের বিরুদ্ধে অপরাধের কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল না। পরবর্তীতে পুলিশ ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে প্রমাণ জোগাড় করেছে।

শাহজাহানপুরের সিনিয়র সুপারিনটেন্ট অব পুলিশ (এসএসপি) এস আনান্দ বলেন, এ মামলা অপ্রত্যাশীত ছিল। যখন ভুক্তভোগী নারী এসে মামলা করতে চেয়েছেন আমরা বিস্মিত হয়েছিলো। তবুও আমরা তার ছেলের কাছ থেকে ডিএনএস নমুনা সংগ্রহ করেছি।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর ধার্মেন্দ্র কুমার গুপ্তা বলেন, আমরা দুই অভিযুক্তের ডিএনএ নমুনা নিয়েছি। ভুক্তভোগীর ছেলেরও নমুনা নিয়েছি। তাদের টেস্টের পর দুই ভাইয়ের এক ভাইয়ের নমুনার সঙ্গে ভুক্তভোগীর ছেলের ডিএনএর নমুনার মিল পাওয়া গেছে।

এর আগে, ৩১ জুলাই মামলায় এক অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া দ্বিতীয় আসামিও পুলিশ কাস্টডিতে রয়েছে। তবে এখনো অভিযুক্তদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ভুক্তভোগী নারী বলছেন, তার এ প্রচেষ্টা অন্য নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা হোক। কারণ অপরাধীর বিরুদ্ধে চুপ থাকে মানুষ। আমিও চুপ ছিলাম। আমিই আমার ভাগ্যকে এভাবে চুপ রেখেছিলাম।

তাই আমাদের অবশ্যই পুলিশের কাছে দ্রুত দ্বারস্ত হতে হবে। ভুক্তভোগী জানান, আজ তার ছেলে সবচেয়ে বড় আনন্দে আছে যে অপরাধীরা ধরা পড়েছে।

শেয়ার করুন