০১ নভেম্বর ২০২৫, শনিবার, ০৩:৫৮:৩৬ পূর্বাহ্ন
শাহজালাল বিমানবন্দরে আগুনে বিপজ্জনক পণ্যে বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২০-১০-২০২৫
শাহজালাল বিমানবন্দরে আগুনে বিপজ্জনক পণ্যে বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে শনিবারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডটি বিমানবন্দরের ‘সিস্টেমিক’ অব্যবস্থাপনা, আধুনিকায়নে চরম অনীহা এবং ঝুঁকিপূর্ণ বস্তু ব্যবস্থাপনায় চূড়ান্ত ব্যর্থতার একটি বহিঃপ্রকাশ মাত্র। যে আগুনে পুড়ে ছাই হলো শত শত কোটি টাকার আমদানি পণ্য, সেই একই ধরনের বা তার চেয়েও বড় বিপর্যয়ের ঝুঁকি নিয়ে সচল রয়েছে বিমানবন্দরের কাস্টমস গুদাম ও হ্যাঙ্গার কমপ্লেক্স।


সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্গো ভিলেজের এই আগুন একটি ‘ওয়েক-আপ কল’। কেননা, কাস্টমসের গুদামে নিয়মবহির্ভূতভাবে ফেলে রাখা হয়েছে বিপুল পরিমাণ নিলাম অযোগ্য দাহ্য রাসায়নিক ও বিস্ফোরক দ্রব্য।


অন্যদিকে উড়োজাহাজ রক্ষণাবেক্ষণের হ্যাঙ্গার কমপ্লেক্সেও নেই অগ্নি দুর্ঘটনারোধে আন্তর্জাতিক মানের স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। এই অগ্নিকাণ্ড বিশ্বব্যাপী কার্গো ব্যবস্থাপনায় অগ্নি নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে আলোচনা সৃষ্টি করেছে। আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় ঢাকার কার্গো টার্মিনালে অগ্নি নিরাপত্তাব্যবস্থায় যে পর্বতপ্রমাণ ঘাটতি রয়েছে, তা এবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

শনিবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে দুপর সোয়া ২টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।


এতে ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় বিমান চলাচল বন্ধ থাকে। পরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, বাংলাদেশ বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সমন্বিত প্রচেষ্টায় ৭ ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএসহ ব্যবসায়ী নেতারা কয়েক বছর ধরেই কার্গো ভিলেজের আধুনিকায়ন ও অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা স্থাপনের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) সেই দাবি পূরণ করতে না পারায় এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল বলে মনে করছেন তাঁরা।


ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে যদি ডিটেকশন ও প্রটেকশন সিস্টেম থাকত, তাহলে এত বড় দুর্ঘটনা হতো না। এমন কোনো ব্যবস্থা আমরা পাইনি। ভবিষ্যতে এখানে এ ধরনের সিস্টেম স্থাপন করা জরুরি।’


আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ (অ্যামচ্যাম) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অত্যন্ত সংবেদনশীল এই স্থানে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা স্থাপনে কেউই সঠিক মনোযোগ দেয়নি। গুদামব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল ও হাতে-কলমে পরিচালিত।


কাস্টম ছাড়পত্র প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতার কারণে পণ্য জমতে থাকে, আর সীমিত স্থানের এই সংকট আরো তীব্র হয়। বিপজ্জনক পণ্যের গুদাম আলাদা এবং অধিক সুরক্ষিত হওয়া উচিত ছিল। এই ঘটনায় শুধু আর্থিক ক্ষতিই নয়, দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হয়েছে।’

কার্গো ভিলেজে আগুন লেগে পুরো আমদানি কার্গো এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনায় বেবিচকের অবহেলা রয়েছে বলে মনে করছেন তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। গতকাল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিমানবন্দরের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ-ব্যবস্থা থাকার কথা। সিভিল এভিয়েশনের কি এই পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না? যদি না থাকে, তাহলে এর পেছনে দায়ী কারা, সেটা সরকারের খুঁজে বের করা দরকার। এর ফলে দেশের ব্যবসায়ীদের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতির পাশাপাশি বহির্বিশ্বে ইমেজ ক্রাইসিস হবে। এ ধরনের একটি কী পয়েন্ট ইনস্টলেশনে (কেপিআই) কিভাবে এত বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে? এটি আমাদের নিরাপত্তাব্যবস্থা কতটা নাজুক অবস্থায় রয়েছে, সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।’


পলিসি এক্সচেঞ্জ অফ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমদানি কার্গো শেডে যে ভয়াবহ আগ্নিকাণ্ড ঘটল তার কারণে আমাদনি করে আনা বিপুল পরিমাণ পণ্যের প্রায় সবই ধ্বংস হয়ে গেছে। এই ঘটনায় আমাদের লজিস্টিক দুর্বলতা আবারও প্রকাশ পেল। এর প্রভাব পড়বে অভ্যন্তরীণ ও রপ্তানি বাজারে। প্রয়োজনীয় স্যাম্পল, যন্ত্রাংশ পুড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ও রপ্তানি ব্যাহত করবে। বিমানবন্দর ও লজিস্টিকসের নিরাপত্তা দুটিই বিশ্বজুড়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’


নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি মো. ফজলুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের পণ্য কতটা বিশৃঙ্খলভাবে পড়ে থাকে তা বিদেশে যাওয়ার সময়ে আমরা প্লেনে চড়েই দেখতে পাই। এত বড় অগ্নিকাণ্ড আমাদের কার্গো ব্যবস্থাপনায় কতটা দুর্দশাগ্রস্ত তা প্রকাশ পেল। আমরা দীর্ঘদিন থেকে দাবি জানিয়ে আসছি এটির সুবিধার উন্নয়ন করার জন্য। আমরা উদ্বিগ্ন, এখানে যে ব্যবসার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতি হলো তা বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। একটা ছোট এক হাজার ডলারের লেবেলের জন্যও এক মিলিয়ন ডলারের শিপমেন্ট বাতিল হয়ে যেতে পারে। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের বিশ্বের সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে যেতে হবে।’


ঝুঁকির শীর্ষে কাস্টমস গুদাম ও হ্যাঙ্গার : শনিবারের অগ্নিকাণ্ডে দেশের প্রধান বিমানবন্দরটির যে নাজুক দশা প্রকাশ পেয়েছে, তাতে ব্যবসায়ী ও এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা আরো বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন।


সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিমানবন্দরের কাস্টমস হাউসের ভেতরের গুদামগুলো এখন নিলাম-অযোগ্য ও বাজেয়াপ্ত করা পণ্যের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিপুল পরিমাণ দাহ্য রাসায়নিক, পারফিউম, বডি স্প্রে, স্পিরিট এবং বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক জাতীয় ‘বিপজ্জনক পণ্য’ (ডেঞ্জারাস গুডস)।


শেয়ার করুন