২৩ নভেম্বর ২০২৪, শনিবার, ০৬:৪৩:১৯ অপরাহ্ন
৭০ টনের গার্ডার তুলছিল ৫০ টনের ক্রেন, ছিল না ফিটনেস
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৮-০৮-২০২২
৭০ টনের গার্ডার তুলছিল ৫০ টনের ক্রেন, ছিল না ফিটনেস

রাজধানীর উত্তরায় প্রাইভেটকারের ওপর নির্মাণাধীন বিআরটি প্রকল্পের যে ক্রেন থেকে গার্ডার পড়ে একই পরিবারের ৫ জন মারা যান সেই ক্রেনটির ছিল না ফিটনেস। ক্রেনটি ছিল অনেক পুরাতন। এর ধারণক্ষমতা ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টন। আর গার্ডারের ওজন ছিল ৬০ থেকে ৭০ টন। গার্ডার তোলার কাজ করার সময় দুটি ক্রেন থাকার কথা থাকলেও ছিল একটি। যে ক্রেনটি ছিল সেটিও ছিল অপেক্ষাকৃত দুর্বল।


এছাড়া থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেড মাসিক ভাড়ার চুক্তিতে ক্রেনটি সরবরাহ করে। প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মকর্তা গ্রেফতার রুহুল আমিন ও মার্কেটিং ম্যানেজার গ্রেফতার তুষার ক্রেনের ভাড়া, চুক্তি, ড্রাইভার নিয়োগ ও ক্রেনের ফিটনেস যাচাইসহ অন্যান্য দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।


বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) দুপুরে কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।


র‌্যাব জানিয়েছে, গ্রেফতার রুহুল ২০১০ সালে এবং গ্রেফতার তুষার ২০১৫ সালে এই প্রতিষ্ঠানে যোগদান করে। তারা অতিরিক্ত লাভের জন্য অল্প পারিশ্রমিকে ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স ছাড়া অপারেটর আল আমিনকে নিয়োগ প্রদান করে। এছাড়াও এই ক্রেনের ফিটনেস যাচাই করা হয়েছিল সর্বশেষ ২০২১ সালে। কিন্তু ২০২২ সালে ক্রেনের কোনো ধরনের ফিটনেস যাচাই করা হয়নি।


তিনি বলেন, গতকাল রাতে র‌্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র‌্যাব-১, ৩, ৪, ৬ ও র‌্যাব-১২ এর যৌথ অভিযানে ক্রেন চালক মো. আল আমিন হোসেন ওরফে হৃদয় (২৫), রাকিব হোসেন (২৩), দুর্ঘটনাস্থলে নিরপাত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের ট্রাফিক ম্যান মো. রুবেল (২৮), মো. আফরোজ মিয়া (৫০), ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার মো. জুলফিকার আলী শাহ (৩৯), হেভি ইকুইপমেন্ট সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত ইফসকন বাংলাদেশ লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী মো. ইফতেখার হোসেন (৩৯), হেড অব অপারেশন মো. আজহারুল ইসলাম মিঠু (৪৫), ক্রেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড কোম্পানির মার্কেটিং ম্যানেজার তোফাজ্জল হোসেন ওরফে তুষার (৪২), প্রশাসনিক কর্মকর্তা রুহুল আমিন মৃধা (৩৩) ও মো. মঞ্জুরুল ইসলামকে (২৯) গ্রেফতার করা হয়।


jagonews24


গত সোমবার (১৫ আগস্ট) বিকেলে রাজধানীর উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের ফ্লাইওভারের গার্ডারচাপায় প্রাইভেটকারে থাকা শিশুসহ পাঁচ যাত্রী নিহত হয়েছেন। আহত হন একই গাড়িতে থাকা এক নবদম্পতি। নিহতরা হলেন- আইয়ুব আলী হোসেন রুবেল (৫৫), ফাহিমা আক্তার (৩৮), ঝর্না আক্তার (২৭), ঝর্না আক্তারের দুই শিশু সন্তান জান্নাত (৬) ও জাকারিয়া (৪)। মঙ্গলবার বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে মরদেহগুলো হস্তান্তর করা হয়।


প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতাররা এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য দিয়েছে বলেও জানিয়েছেন র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা।


তিনি বলেন, গত ১৫ আগস্ট রাজধানীর উত্তরার জসীমউদ্দিন রোডে বিকেল সোয়া চারটায় নির্মাণাধীন বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের ক্রেন থেকে গার্ডার ছিটকে প্রাইভেটকারের ওপরে পড়ে। এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই একই পরিবারের পাঁচজনের মৃত্যু হয় এবং দুজন গুরুতরভাবে আহত হন। দুর্ঘটনার পর দ্রুত সময়ে র‌্যাব সদরদপ্তরের উদ্ধার টিম ও র‌্যাব-১ এর একটি দল সর্বপ্রথম উদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নেয়। পরবর্তীসময়ে ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে চারঘণ্টাব্যাপী উদ্ধারকাজে চালিয়ে যায়।


এসময় র‌্যাবের সহায়তায় অন্য একজন ক্রেন অপারেটর নিয়ে এসে গার্ডার উঁচু করে দুর্ঘটনা কবলিত গাড়ি এবং নিহতদের উদ্ধারে সহায়তা করা হয়। দুর্ঘটনায় ভুক্তভোগীদের পরিবারের পক্ষ থেকে ওই রাতেই রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় বিআরটির অবহেলাজনিত কারণে একটি মামলা দায়ের করা হয়।


প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারদের বরাত দিয়ে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, বিআরটি প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গেজুবা গ্রুপ কোম্পানির (সিজিজিসি) তত্ত্বাবধানে ক্রেন দিয়ে প্রকল্পের গার্ডার উত্তোলনের কাজ চলাকালীন এ দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। দুর্ঘটনায় ঘাতক ক্রেনের চালক/অপারেটর মো. আল আমিন ও হেলপার রাকিব হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়।


ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি থেকে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের ওয়ার্ক অর্ডার পায় ইফসকন নামক একটি প্রতিষ্ঠান। যার স্বত্বাধিকারী গ্রেফতার ইফতেখার হোসেন ও হেড অব অপারেশন গ্রেফতার আজহারুল ইসলাম মিঠু। ভারী যন্ত্রপাতি ওঠানামার জন্য ইফসকনের কাছে বড় ক্রেন না থাকায় তারা থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড কোম্পানির কাছ থেকে ক্রেনটি ভাড়া নেয়। এছাড়াও প্রকল্প এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্বে থাকা ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের ট্রাফিক ম্যান আফরোজ ও রুবেল এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসির সেফটি ইঞ্জিনিয়ার জুলফিকার আলীকে প্রকল্প এলাকায় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং হেভি ইকুইপমেন্ট সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকা সিজিজিসির প্রকিউরমেন্ট কর্মকর্তা মঞ্জুরুল ইসলামকে দায়িত্বে অবহেলার কারণে গ্রেফতার করা হয়।




 


ঘাতক ক্রেনের মূল অপারেটর আল আমিন। তার হালকা গাড়ি চালানোর অনুমোদন থাকলেও ভারি গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেই। ২০১৬ সালে ক্রেন চালনার প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর দু-তিনটি নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করে সে। ২০২২ সালের মে মাসে বিআরটি প্রকল্পে ক্রেন অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করে। গ্রেফতার রাকিব তিন মাস আগে এ প্রকল্পের ক্রেন হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করে। তার ক্রেন চালনার কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছিল না।


দুর্ঘটনার দিন আল আমিন ও রাকিব দুপুর ২টা থেকে ক্রেন চালনা শুরু করে। একটি গার্ডার স্থাপন শেষে দ্বিতীয় গার্ডার স্থাপনের সময় ক্রেনের ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত ওজনের গার্ডার উত্তোলনের কারণে ক্রেনটি নিয়ন্ত্রণ হারায়। এতে গার্ডারটি প্রাইভেটকারের ওপর ছিটকে পড়লে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা ঘটে। এসময় হেলপার রাকিব ক্রেন চালনা করছিল এবং ক্রেন অপারেটর আল আমিন ক্রেনের বাইরে থেকে নির্দেশনা দিচ্ছিল। দুর্ঘটনার পর অপারেটর আল আমিন ও হেলপার রাকিব ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।


সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাবের এ কর্মকর্তা আরও জানান, ইফসকন কোম্পানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি থেকে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য ওয়ার্ক পারমিট পায়। গার্ডার বহনের ক্রেন এ প্রতিষ্ঠানের কাছে না থাকায় বিল্ড ট্রেডার্স নামক প্রতিষ্ঠান থেকে অপারেটর ও হেলপারসহ এ ক্রেনটি মাসিক চুক্তির ভিত্তিতে ভাড়া নেয়। ইফসকনের স্বত্বাধিকারী গ্রেফতার ইফতেখার ও হেড অব অপারেশন গ্রেফতার মিঠু অপারেটরদের দক্ষতা, যোগ্যতা ও ক্রেনের ফিটনেস যাচাই না করেই গুরুত্বপূর্ণ জনবহুল সড়কে ভারি গার্ডার স্থাপনের কাজে নিয়োজিত করছিলেন। এছাড়া গার্ডার স্থাপনের সময় অতিরিক্ত একটি সহায়ক ক্রেন উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও সেটি ছিল না।


কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ার লিমিটেডের মাসিক ভাড়ার চুক্তিতে ক্রেন সরবরাহ করে। প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক কর্মকর্তা গ্রেফতার রুহুল আমিন ও মার্কেটিং ম্যানেজার গ্রেফতার তুষার ক্রেনের ভাড়া প্রদান, চুক্তি, ড্রাইভার নিয়োগ ও ক্রেনসমূহের ফিটনেস যাচাইসহ অন্যান্য দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। গ্রেফতার রুহুল ২০১০ সালে ও গ্রেফতার তুষার ২০১৫ সালে এ প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন। তারা অতিরিক্ত লাভের জন্য অল্প পারিশ্রমিকে ভারি গাড়ি চালানোর লাইসেন্স ছাড়া অপারেটর আল আমিনকে নিয়োগ দেয়। এছাড়াও ক্রেনের সর্বশেষ ফিটনেস যাচাই করা হয়েছিল ২০২১ সালে। চলতি বছর ক্রেনের কোনো ধরনের ফিটনেস যাচাই করা হয়নি।


গ্রেফতার রুবেল তিন মাস আগে ও গ্রেফতার আফরোজ গত মাসে ফোর ব্রাদার্স গার্ডস সার্ভিস ট্রাফিকম্যান হিসেবে এ প্রকল্পে যোগ দেন। তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কোনো প্রশিক্ষণও ছিল না। দুর্ঘটনার সময় তারা সেখানে প্রকল্পের ট্রাফিকম্যান হিসেবে নিয়োজিত ছিল।

শেয়ার করুন