২৪ নভেম্বর ২০২৪, রবিবার, ১১:১১:৪৮ পূর্বাহ্ন
ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি-নির্যাতনে আতঙ্কিত শিক্ষার্থীরা, বিব্রত রাবি প্রশাসন
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৮-০৮-২০২২
ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি-নির্যাতনে আতঙ্কিত শিক্ষার্থীরা, বিব্রত রাবি প্রশাসন

ছাত্রলীগের একের পর এক চাঁদাবাজি এবং শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে নির্যাতনের ঘটনায় ‘বিব্রত’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এসব ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের  শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে চরম উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে।  বিশেষ করে মারধরের শিকার হয়ে এক শিক্ষার্থী বাড়ি চলে যাওয়ার পর থেকে শিক্ষার্থীদের মাঝে আরও আতঙ্ক তৈরী হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তাও ছাত্রলীগের এমন কাণ্ডে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন।

অনুসন্ধান ও বিভিন্ন সূত্র শতে, নির্যাতন ও চাঁদাবাজির ঘটনায় গত ১১ আগস্ট থেকে গতকাল ২৭ আগস্ট পর্যন্ত ১৭ দিনে মোট পাঁচটি অভিযোগ পাওয়া গেছে রাবি ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে দুইটি অভিযোগ গুরুতর। যেখানে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীকে ‘পাশবিক’ শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে।

ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে জানা গেছে, গত ১৭ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে তিন ঘণ্টা আটকে রেখে আল-আমিন নামের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন ও জোরপূর্বক তার ডেবিট কার্ড থেকে ৪৫ হাজার টাকা তুলে নেওয়া হয়। অভিযুক্তরা হলেন, মার্কেটিং বিভাগের ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মুমিনুর রহমান, ফয়সাল আহমেদ শশী ও তাকি আহমেদ এবং রাবি ছাত্রলীগের সহসভাপতি সুরঞ্জিত প্রসাদ বৃত্ত ও মতিহার হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহা। এ ঘটনায় ওই শিক্ষার্থী গত ২৫ আগস্ট বৃহস্পতিবার তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হকের কাছে কুরিয়ারের মাধ্যমে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নির্যাতনের কারণে বাঁ কানে কিছু শুনতে পাচ্ছেন না বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী আল-আমিন। শারীরিক নির্যাতন ও টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে অভিযুক্তরা।

রাবি ছাত্রলীগের সহসভাপতি সুরঞ্জিত বলেন, ‘আমি এই ধরনের কোনো ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। কারা করেছে বলতে পারবো না।

ওই ঘটনার মাত্র দুদিন পরেই গত ১৯ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সামছুলের কাছে চাঁদা দাবি করেন মতিহার হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর সাহা। চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় মতিহার হলের ১৩২ নম্বর কক্ষে তাকে তিনঘণ্টা ধরে শারীরিক নির্যাতন করে ২০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেন। শারীরিক নির্যাতনে সামছুলের বাঁ কানের পর্দা ফেটে গেছে। এ ঘটনায় প্রক্টর দফতরে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী। অভিযোগের প্রেক্ষিতে প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক তিনসদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তবে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশের আগে প্রক্টরের কাছে অভিযোগ তুলে নেওয়ার আবেদন করেন ভুক্তভোগী। এ ঘটনায় অভিযুক্ত ভাস্কর সাহা সামছুলের সঙ্গে তার মীমাংসা হয়েছে বলে জানিয়েছেন। ভাস্কর সাহা ওই শিক্ষার্থীর নিকট ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন বলেও জানান গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে। তবে ওপরের দুটি ঘটনায় বর্তমানে তদন্ত কমিটির কাজ চলমান রয়েছে।

গত ২১ আগস্ট শহিদ জিয়াউর রহমান হলের সামনের হোটেল মালিক মানিক হোসেন বাবু অভিযোগ করে জানান, মাসে ত্রিশ হাজার করে চাঁদা দেন ওই হল শাখা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রাশেদ মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলামকে বলে সাংবাদিকদের জানান।

হোটেল মালিক মানিক হোসেন বাবু বলেন, চাঁদাবাজির পাশাপাশি তারা হোটেলে নিয়মিত বাকিতে খাবার খান ওই দুই নেতা। দোকানে তাদের প্রায় ১০ হাজার টাকা মতো বকেয়া রয়েছে। তবে চাঁদাবাজির বিষয়টি অস্বীকার করে হল শাখা শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রাশেদ মিয়া বলেন, ‘এটি মোটেও সম্ভব নয়। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছে। একই দাবি করেন সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলামও।

গত ১১ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ হবিবুর রহমান হলের সামনের এক মুদি দোকানদারের কাছে চাঁদা দাবি করা হয়। না দেওয়ায় তার ৫০ হাজার টাকা লোপাটের অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের তিন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত নেতারা হলেন, রাবির শহীদ জিয়াউর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. রাশেদ মিয়া, হবিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সামিউল আলম সোহাগ ও আইবিএ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আবু সিনহা। তবে অভিযুক্ত সকল নেতাকর্মীরা টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। এঘটনার পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ভুক্তভোগীকে লিখিত অভিযোগ ও থানায় মামলা করতে বলেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

জানতে চাইলে আইবিএ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আবু সিনহা বলেন, এটি মোটেও সঠিক নয়। আমি এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।

গত ৬ আগস্ট শহিদ হবিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠে। ক্যাম্পাসে নির্মাণাধীন ২০ তলা একাডেমিক ভবনের ঠিকাদারের কাছে তিনি ৩০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন। চাঁদাবাজির বিষয়ে মোমিন বলেন, চাঁদা নয়, ঈদ সেলামি চেয়েছি। এ ঘটনায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে জানানো হয়, এর আগেও মোমিনুল তাদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করেছেন। এ ঘটনার পরেও প্রক্টর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে থানায় মামলা করতে বলেছেন বলে জানান।  এর বাইরেও একের পর এক চাঁদাবাজি ও শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত হয়ে পড়ছে রাবি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আর এসব ঘটনায় আতঙ্ক বিরাজ করছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে।

রাবির একাধিক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মাঝে খুব শান্ত ছিলো রাবি। কিন্তু হঠাৎ বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তারা চাঁদাবাজি আর সিট বাণিজ্যে মেতে উঠেছেন। এসব করতে গিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন করছেন তারা। কেউ প্রতিবাদ করছে, আবার কেউ ভয়ে মুখ খোলার সাহস পাচ্ছে না। এ নিয়ে আমরাও চরম আতঙ্কে আছি। কখন কাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে, সেটি নিয়ে মূলত আতঙ্ক বিরাজ করছে।

জানতে চাইলে রাবি শাখা ছাত্রলীগের গোলাম কিবরিয়া বলেন, আমরা নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট প্রমাণ পেলে অবশ্যই সাংগঠনিক নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো।

ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, সিটদখল , নির্যাতনের বরাবরই প্রতিবাদ করে আসছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মো. ফরিদ উদ্দিন খান। গত ২৬ জুন এসবের প্রতিবাদে শহীদ শামসুজ্জোহা চত্বরে তিনি প্রতীকী অনশনে বসেন। ছাত্রলীগের বর্তমান বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটা স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সর্বপ্রথম এগিয়ে আসতে হবে। উনারা যদি কঠোর না হয়, তাহলে এখান বেরিয়ে আসার উপায় নেই। তারা যদি এই সমস্যার সমাধান করতে না পারে, তবে নৈতিকভাবে তাদের ওই পদে থাকা ঠিক হবে না। ছাত্রদের নিরাপত্তা ও স্বার্থ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান। এখন সেইটা তারা যদি এই সমস্যার সমাধান করতে না পারে, তবে নৈতিকভাবে তাদের ওই পদে থাকা ঠিক হবে না। ছাত্রদের নিরাপত্তা ও স্বার্থ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান। এখন সেইটা যদি তারা নিশ্চিত করতে না পারে নৈতিকভাবে পদ বসে থাকা ঠিক হয় না। এখানে অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। তারা নিরুপায় মানে কি, তারা যদি কঠোর সিদ্ধান্ত নেই ছাত্রলীগ এসে তাদের পেটাবে নাকি? অবশ্যই পেটাবে না। তাহলে কিসের ভয় এতো?

সিন্ডিকেট সদস্য সাদিকুল ইসলাম সাগর বলেন, এই ঘটনাগুলোর কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পরিবার খুবই বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। এই ঘটনায় দুইটি তদন্ত কমিটিও হয়েছে। আর সামনে সিন্ডিকেটের সভায় আমরা বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবো।

ছাত্র-উপদেষ্টা অধ্যাপক তারেক নূর বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক বলেন, আমরা ছাত্রলীগের বর্তমান ঘটনাগুলোয় বিব্রতবোধ করছি‌। বিশেষ করে সামছুলের ঘটনায়। শুনেছি তার কানের পর্দা ফেটে গেছে। আমরা তার চিকিৎসার দায়িত্ব বহন করবো। আমরা খুব দ্রুত ক্যাম্পাসের সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসতে যাচ্ছি। আলোচনায় তাদেরকে সতর্ক দেয়া হবে , যাতে এ ধরনের বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি না হয়‌।

উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, ক্যাম্পাসে যা কিছুই ঘটুক না কেনো, যা কিছু স্বাভাবিক না, তাতে তো আমরা সকলেই বিব্রতবোধ করি। শুধু প্রশাসন কেনো গোটা বিশ্ববিদ্যালয় বিব্রতকর অবস্থায় আছে। দুইটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির ফলটা হয়তো আসতে দেরি হচ্ছে।

ক্যাম্পাসে আগস্ট মাসের মধ্যে পাঁচটি ঘটনা ঘটেছে এ বিষয়ে কি বলবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরাও সাধারণভাবে উদ্বিগ্ন এই বিষয়গুলো নিয়ে। কারণ, আমরা চাই না একজন শিক্ষার্থী আরেকজন শিক্ষার্থীর ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করুক। আমরা চাই শিক্ষার্থীরা যে যার পড়াশোনা, গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে।

রাবিতে একের পর এক ছাত্রলীগের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে প্রশাসন বিব্রত কিনা এমন প্রশ্নে উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্ৰহণ করা হয়েছে। দুইটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। প্রক্টর এবং উপ-উপাচার্য এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন।

শেয়ার করুন