রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে পদোন্নতির নামে ব্যাপক অনিয়ম ও বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে ব্যাংকটির অভ্যান্তরে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকেও ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয় রাজশাহী শাখায় বছরের পর বছর ধরে কর্মরত একটি সিন্ডিকেট এই পদোন্নতির বাণিজ্যের মূলহোতা বলে দাবি করেছেন ভূক্তভোগী কর্মকর্তরা।
ভূক্তভোগীদের দাবি, প্রধান কার্যালয়ের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের একটি সিন্ডিকেটের হাতে ব্যাংকটি মূলত জিম্মি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পরিদর্শন প্রতিবেদনেও প্রধান কার্যালয়ে ৭-১২ বছর ধরে ২০-২৫ জন কর্মকর্তার নামে আপত্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অদ্যবধি সেই কর্মকর্তারাই দাপটে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। তাঁদেরই কাউকে কাউকে নিয়ম লঙ্ঘন করে নতুন করে পদোন্নতি দেওয়ার চেষ্টা চলছে। আগামী ১৬-২৬ অক্টোবর পর্যন্ত এই পদোন্নতির ভাইভা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
বর্তমানে সরকার কর্তৃক নিয়োগকৃত ৩ জন সিনিয়র জিএম থাকা সত্ত্বেও উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) শওকত শহীদুল ইসলামকে গত ১ সেপ্টেম্বর ব্যাংকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন পদে জিএম (প্রশাসন) চলতি দায়িত্বে পদায়ন করা হয়েছে। এ কাজটি করতে গিয়ে জ্যেষ্ঠ ১৯ জন উপ-মহাব্যবস্থাপককে ডিঙ্গিয়ে শওকত শহিদুল ইসলামকে জিএম প্রশাসন পদে (চলতি দায়িত্বে) পদায়ন করা হয়েছে। শওকত শহিদুল ওই পদে পদায়ন করা হলেও পূর্ণাঙ্গ জিএম হিসেবে আরও তিনজন কর্মকর্তা আছেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যেও কাউকেই সেই গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়নি।
সূত্র মতে, জনাব শওকত শহীদুল ইসলাম রাকাব অফিসার্স এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক। সেই কমিটিরও মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু নিজের ক্ষমতাবলে নির্বাচন দেওয়া হচ্ছে না। তাকে জিএম (চলতি দায়িত্ব) পদে পদায়ন করা হলেও তাঁর কার্যালয়ের দরজায় সরাসরি জিএম প্রশাসন লিখে রাখা হয়েছে। সাধারণত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ পদে সিনিয়র জিএম প্রশাসনের দায়িত্ব পেয়ে থাকেন।
এমনকি সরকারি চাকরি বিধি মতে, নিয়োগপ্রাপ্ত কোনো জিএম না থাকলে একজন সিনিয়র ডিজিএমকে (ডিজিএম হিসেবে তিন বছর পূর্তি হয়েছে এমন কাউকে) জিএম পদে পদায়ন করা যেতে পারে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন সাপেক্ষে। সেই নীতিমালা ভঙ্গ করে ৩ জন জিএম এবং ১৯ জন সিনিয়র ডিজিএম থাকা সত্ত্বেও জুনিয়র ডিজিএম শওকত শহিদুল ইসলামকে জিএম পদে বসানো হয়েছে। অথচ তাঁর মাত্র ডিজিএম হিসেবে এক বছর সময় কেটেছে।
রাকাব সূত্র মতে, আইসিটি বিভাগের ডিজিএম আবুল কালাম এবং বিভাগীয় নিরীক্ষা কার্যালয়ের ডিজিএম আরিফুজ্জামানকে জিএম পদে পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করে অর্থ মন্ত্রণারয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। অথচ চাকরি বিধি মতে, এই পদের জন্য ১৫ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু তাঁদের অভিজ্ঞতা রয়েছে ১২ বছর। আবার এখানেও অপর দুই উপ-মহাব্যবস্থাপক রনজিৎ কুমার সেন ও মোসাদ্দেক হোসেনকে ডিঙ্গিয়ে আবুল কালাম এবং আরিফুজ্জামানকে জিএম হিসেবে পদোন্নতি দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
এর আগে নীতি বর্হিভুতভাবে আবুল কালাম ও আরিফুজ্জামানকে চাকরির ৮ বছর পূর্তিতেই ডিজিএম (৩য় গ্রেডভুক্ত) পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। যদিও তারা এখনও ৫ম গ্রেডের বেতন পাচ্ছেন। এখন আবার ২য় গ্রেডে (জিএম) পদোন্নতি দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
এদিকে, বাংলাদেশ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত-কর্মচারীদের ৩ বছর পরপর বদলী করার নিয়ম থাকলেও এই সিন্ডিকেটের অনেকেই ৭ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত রাকাবের প্রধান কার্যালয়ে বহাল তবিয়তে আছেন ১৫-২০ জন কর্মকর্তা। যাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন, উপমহাব্যবস্থাপক শওকত শহীদুল ইসলাম (জিএম চলতি দায়িত্ব), ডিজিএম মিজানুর রহমান, এসপিও সাদিকুল ইসলাম, হাকিম দেওয়ান, মুকুল কুমার বর্দ্ধন, আব্দুল মালেক, কাওসার জাহান, ইকবাল হোসেন খান ও মোঃ জামিল, পিও সাজ্জাদ হোসেন, মাইফুল রানী, জোবাইদা নাসরীন ও রোমানা আফরোজ।
গত বছরের ৩০ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন প্রতিবেদনে এই অনিয়মের বিষয়টি উঠে আসে। এর পর তাঁদের বদলির সুপারিশ করা হলেও সেটি কার্যকর করা হয়নি। রাকাব সিন্ডিকেটের কারণে এখনো তাঁদেরই কাউকেই পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে।
অপরদিকে, জ্যেষ্ঠতা তালিকা নিয়েও ব্যাংকে বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে ব্যাংকটিতে। এ নিয়ে ১৮টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। ২০১১ ও ২০১৪ সালের জ্যেষ্ঠতা তালিকায় ২০১০ সালে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত ৫৬ জন সিনিয়র কর্মকর্তার ১৯৯৮ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত জুনিয়র কর্মকর্তাদের উপরে পদায়ন ছিল।
কিন্তু প্রায় ৬ বছর পর রাকাবের কর্মীব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে ২০২০ সালে প্রকাশিত জ্যেষ্ঠতা তালিকায় দেখা যায় যে, ২০১০ ব্যাচের ৫৬ জন সিনিয়র অফিসার এবং ১৯৯৮ সালে নিয়োগপ্রাপ্ত ১০৯ জুনিয়র অফিসার সবাইকে সিনিয়র প্রিন্সিপাল কর্মকর্তা হিসেবে পদায়ন হয়। তবে সেখানেও ২০১০ সালের ৫৬ জন কর্মকর্তাকে জ্যেষ্ঠতা প্রদান না করে ১৯৯৮ সালের জুনিয়র কর্মকর্তাদের সেটি করা হয়।
এর পর ২০১০ সালের সিনিয়র অফিসার ব্যাচের ১৮ জন কর্মকর্তা জ্যেষ্ঠতা ফিরে পেতে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে (বগুড়া) ১৮ট মামলা দায়ের করেছেন। যা এখনো বিচারাধীন আছে। মামলা নিস্পত্তি না হলেও এরই মধ্যে ওই ১০৯ এসপিও পদের কর্মকর্তাদের এজিএম পদে পদোন্নতি দিতে তোড়জোড় চলছে। ৬০ শূণ্য এজিএম পদের বিপরীতে রাকাবের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ আবারও পদোন্নতি বাণিজ্যে মেতে উঠেছেন নিয়ম লঙ্ঘন করে।
আগামী ১৬ অক্টোবর থেকে ওই ১০৯ কর্মকর্তার পদোন্নতি ভাইভা হওয়ার কথা রয়েছে। পর্যায়ক্রমে তাঁদেরকে ভাইভা বোর্ডে উপস্থিত হতে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। ৪ সদস্যের এই ভাইভা বোর্ডে থাকবেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব কামরুল হাসান মারুফ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের জিএম মির্জা আব্দুল মান্নান। অন্য তিনজন রাকাবের তিন কর্মকর্তা থাকবেন। যাদের মধ্যে থাকবেন বিতর্কিত কর্মকর্তা শওকত শহিদুল ইসলামও। অপরজন হলেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহিদুল হক।
আরেকটি সূত্র মতে, অর্থ মন্ত্রণালয়ে পদোন্নতি নীতিমালা ২০১১ অনুযায়ী পিও হতে এসপিও এবং এসপিও হতে এজিএম পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে অন্তত ২ বছর শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু সেই শর্ত লঙ্ঘন করে ওই ১০৯ জনের মধ্যে ৭ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতির জন্য ডাকা হয়েছে। যাদের দুই বছরের শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে অভিজ্ঞতা নাই।
এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য জিএম (চলতি দায়িত্বে) শওকত শহিদুল ইসলামকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, ‘এসব নিয়ে আমার কোনো মন্তব্য নাই। যা কিছু হয়েছে প্রশাসনিক নিয়ম মতেই হয়েছে।’
জানতে চাইলে রাকাবের চেয়ারম্যান রইছ উল আলম মণ্ডল বলেন, ‘চলতি দায়িত্ব একটি সাময়িক প্রক্রিয়া। এটি তেমন বড় কোনো ইস্যু নয়। একদিন আছে, তো যে কোন সময় নাও থাকতে পারে।’
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জ্যেষ্ঠ লঙ্ঘনের বিষয়টি একটি জটিল প্রক্রিয়া। এটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। আমি আসার আগে থেকেই হয়ে আসছে। এখন কিভাবে এটিকে স্বাভাবিক করা যায়, সেদিকটা দেখছি আমরা। অভিযোগ আছে অনেক। সেসব মাথায় নিয়ে পরবর্তি পদোন্নতির বিষয়ে খেয়াল রাখা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাকাবের সামগ্রিক স্বার্থ নিয়ে কেউ কথা বলে না। কথা বলে শুধু নিজেদের স্বার্থ নিয়ে। এখানে কাউকে কোনো জায়গায় বদলি করা হলে ১৫-২০টি তদবির আসে। কিন্তু রাকাবের উন্নতির জন্য কাজ করেন এমন কর্মকর্তা তেমন নাই। আমরা অনেক কষ্টে ব্যাংকটিকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। যারা ভালো কিছু করছেন, তাঁদের সেসব স্থানে বসানো হচ্ছে।’