২৩ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ১১:০৮:০৪ অপরাহ্ন
নরসিংদী কারাগারে বাড়ছে বন্দি নির্যাতন, হাত বাড়ালে মিলছে মাদক!
  • আপডেট করা হয়েছে : ২১-১২-২০২২
নরসিংদী কারাগারে বাড়ছে বন্দি নির্যাতন, হাত বাড়ালে মিলছে মাদক!

নরসিংদী জেলা কারাগারে প্রতিনিয়ত বন্দি নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলছে। অভিযোগ দিলেও সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়ায় তা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে বলে দাবি করেছে সাধারণ বন্দিরা।

এমনকি ফজর আলী নামের এক বন্দির মৃত্যুও নির্যাতনের কারণে বলে দাবি করেছে পরিবার। যদিও কারা কর্তৃপক্ষের দাবি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ওই বন্দির মৃত্যু হয়েছে।

কিন্তু এ ঘটনার সময় দায়িত্ব পালন করা কারারক্ষীর লিখিত জবানবন্দিতে নির্যাতনের বিষয়টি উঠে এসেছে। বর্তমানে নরসিংদী জেলা কারাগার যেন অপরাধের স্বর্গরাজ্য। কারাগারে বসে নগদ টাকা থাকলে হাত বাড়ালেই মিলছে মাদক ইয়াবা ও গাঁজা। অভিযোগ আছে, নরসিংদী জেলা কারাগারে সুপার শফিউল আলম ও সুবেদার হেলাল উদ্দিন সিন্ডিকেটের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে হাজতিদের ওপর চলে অমানুষিক নির্যাতন। সরেজমিনে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে লোমহর্ষক অনেক তথ্য। নতুন আসামিদের আমদানি ওয়ার্ডে কেনাবেচা, সিট বাণিজ্য, ক্যান্টিন বাণিজ্য, মোবাইল কল বাণিজ্য, মাদক বাণিজ্য, বন্দি কেনাবেচা বাণিজ্য-সবই যেন ওপেন সিক্রেট। সুপার ও সুবেদারকে ম্যানেজ করে মাদক কারাগারে ঢুকানো হয় বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, নরসিংদী জেলা কারাগারে এসব মাদক বিক্রির সিন্ডিকেটে জেল সুপার ও সুবেদার হেলাল, কারারক্ষী জিলানী, পলাশ, দুলাল ও স্বপন সরাসরি জড়িত। এ নিয়ে ১৬ নভেম্বর নরসিংদী জেলা কারাগার পরিদর্শনে যান জেলা সিভিল সার্জন ডাক্তার মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম ও একটি মেডিকেল টিম। পরিদর্শন শেষে কারাভ্যন্তরে মাদকের ভয়াবহতা দেখে তিনি স্মারক নং ০৭/২২তে কারাগারের ভেতরের মাদক পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি জেলা কারাগারকে মাদকমুক্ত করতে পরামর্শও দেন।

বন্দিদের বেচাকেনার হাট : কারাগারের বিভিন্ন ওয়ার্ডের বন্দি বিক্রির প্রধান কেন্দ্র হলো আমদানি ওয়ার্ড ও সেল। এসব রুম থেকে মাসিক আদায় করা হচ্ছে উচ্চ হারে ভাড়া। টাকা দিলে সেখানে মেলে সুযোগ-সুবিধা। প্রভাবশালী বিত্তবান বন্দিদের জন্য রয়েছে সেখানে আলাদা সুযোগ-সুবিধা। দাবি করেছেন সম্প্রতি কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হওয়া কয়েকজন আসামি। তারা যুগান্তরের কাছে কারাগারের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেন।

ওই ভুক্তভোগীরা বলেন, আমদানি ওয়ার্ড ও সেলকে কেন্দ্র করে প্রতিমাসে জেল সুপার, তার সুবেদার, পিআই ও সদস্যরা মিলে ৫ লাখ থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করেন। সেল ও আমদানি ওয়ার্ড হলো আসামি বেচাকেনার একধরনের হাট। ব্যবসায়ী ও বিত্তবান আসামিরা সরাসরি টাকার বিনিময়ে চলে যায় কারা হাসপাতালে। আর সাধারণ কয়েদি ও দাগি আসামিরা সাধারণ ওয়ার্ডে থাকলেও মাসিক হিসাবে গুনতে হয় ৩ হাজার টাকা, যা সুপারের নির্দেশে সুবেদার হেলাল নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। ওয়ার্ডে ও সেলে সাধারণ বন্দিদের টাকা ছাড়া অবস্থানের কোনো সুযোগ নেই।

সদ্য কারামুক্ত আজমল ও মোশাররফ যুগান্তরকে জানান, কোন কোন বন্দি আমদানি ওয়ার্ডে ও সেলে থাকবে, তা কারাগারে প্রবেশের পর নির্ধারণ করা হয়। কারণ মাসিক ভাড়া নির্ধারিত হলে এদেরকে আমদানি ওয়ার্ড বা সেলে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। আর ভালো খাবারের জন্য সাপ্তাহিক হিসাবে আলাদা নগদ টাকা দিতে হয় বন্দিদের। আমদানি ওয়ার্ড ও সেলে থাকতে হলে ৩ হাজার টাকা লাগে। লেনদেন নগদে। বাকির কোনো কারবার নেই। বিকাশের মাধ্যমে কারারক্ষীদের দিয়ে এ চাহিদা পূরণ করা হয়।

কারাগারের ভেতরে সুবেদারের দায়িত্ব নিতে দিতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা : নরসিংদী জেলা কারাগারে সুবেদারের দায়িত্ব পালন করতে হলে জেল সুপারকে মাসোহারা দিতে হয়। কোন সুবেদার কত টাকা মাসিক আদায় করে দিতে পারবে, এর ওপর নির্ভর করে কারাগারের ভেতরে দায়িত্ব পায়। যে বেশি টাকা দিতে পারে, সে-ই ভেতরে ডিউটি করতে পারে। অনেক সময় মাসিক ৩-৪ লাখ টাকা চুক্তিতে দুই মাসের জন্য কারাগারের ভেতরে সুবেদার হিসাবে নিয়োগ পান। দুই মাস পরপর নিলাম হয়-এমন রীতি চালু রেখেছেন সুপার শফিউল আলম।

অপরাধ যত বড়ই হোক, কেস টেবিলে টাকায় মেলে মুক্তি : কারাগারে কোনো বন্দি অপরাধ করলে সেটা বিচার করা হয় কেস টেবিল নামের কারাগারের এক বিচারালায়ে। সেখানেও অপরাধীদের সঠিক বিচার করা হয় না নরসিংদী জেলা কারাগারে। কারণে-অকারণে বিভিন্ন ওয়ার্ডে দায়িত্বরত কারারক্ষীদের মাধ্যামে নতুন সচ্ছল থাকা আসামিদের মারামারি বা জুয়া খেলছে-এমন কিছু ইস্যু দাঁড় করিয়ে পুরোনো আসামিকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে কেস ধরা হয়। পরে সুপার ফাইল (জেল সুপার সাহেবের বিচার) করা হবে বলে ভয় দেখিয়ে কেস টেবিলে হাজির করা হয়। পরে অশালীন গালমন্দ ও ওয়ার্ড পরিবর্তনের ভয় দেখিয়ে এসব কঠিন শাস্তির ভয়ে চলে দরকষাকষি। এ কেস টেবিলের বিচার থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে গুনতে হয় ব্যক্তিবিশেষে মোটা অঙ্কের টাকা। আর কখনো কখনো টাকা না দিলে ওয়ার্ড পরিবর্তন করার ভয় দেখানো হয়। ওয়ার্ড পরিবর্তনের জন্য গুনতে হয় ৪-৫ হাজার টাকা। এসব বিচার করেন কারাগারের সুবেদার হেলাল উদ্দিন। আবার সুবেদার হেলাল উদ্দিন টাকা পেলে সুপার শফিউল আলমের নির্দেশে পার পেয়ে যায় এসব সাজানো অপরাধ থেকে। এসব কথা সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া কয়েকজন বন্দির। আর সুবেদারের চাহিদামতো টাকা না পেলে উলটো শাস্তি পেতে হয় হেলালের সাজানো নিরাপরাধীকে।

কারাগারে আসামি ঢোকানোর সময় তল্লাশির নামে যা করা হয় : আদালত থেকে নতুন আসামি জেলগেটে পৌঁছানোর পর প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকানো হয়। পরে হাজতিদের আলাদা একটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রবেশের সময় দেহ তল্লাশি করা হয়। এ সময় হাজতিদের কাছে যা কিছু থাকে সব হাতিয়ে নেওয়া হয়। হাজতিদের কারাগারে প্রবেশের আগে তাদের নাম, বাবার নাম ও ঠিকানা একটি খাতায় লিপিবদ্ধ করেন কারাগারের অফিস রুমে। ওই খাতার নাম হলো ‘পিসি বই’। হাজতি মুখে তার পরিচয় সঠিক বললেও লেখার সময় অনেকটাই ইচ্ছা করে পিসি বইয়ে ভুল তথ্য লেখা হয়ে থাকে। পরে আদালত থেকে তার জামিন মঞ্জুর হলেও নাম-ঠিকানা ও তথ্যের গরমিলের বেড়াজালে আটকে দেওয়া হয় আসামিকে। আবার নগদে ৩-৫ হাজার টাকা দিলে ভুল হওয়া তথ্য সহজে ঠিক হয়ে যায়। কেউ টাকা দিতে না পারলে জামিন আদেশের পরও তাকে অতিরিক্ত জেলহাজতে থাকতে হয়।

মোবাইল বিল দেয় সরকার, নগদ টাকা নেন সুবেদার : নরসিংদী জেলা কারাগারে ব্যবহৃত মোবাইলের বিল সরকার পরিশোধ করলেও কারাগারের ভেতরে মোবাইল কল বাণিজ্যিকভাবে চলে আসছে। নিয়মমাফিক সাপ্তাহে একদিন ১০ মিনিট কথা বলার সুযোগ পাবে প্রত্যেক কয়েদি ও হাজতি। কিন্তু নরসিংদী জেলা কারাগারের চিত্র তার উলটো। এখানে এক হাজার টাকায় আট মিনিট কথা বলার সুযোগ পায় বন্দিরা। শুধু তাই নয়, টাকা থাকলে প্রতিদিন মোবাইলে কথা বলা যায়। এতে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। কারাগারে বন্দিদের জন্য বরাদ্দ মোবাইলের বিল বন্দি সেবায় পরিশোধ করছে সরকার। আর টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সুবেদার ও সুপার শফিউল আলমের সিন্ডিকেট।

কারা সূত্রে জানা যায়, চলতি মাসের ১২ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় একজন ডিআইজি নরসিংদী কারাগার পরিদর্শনে গেলে বন্দিরা অভিযোগ করেন যে বন্দিদের নির্যাতন এবং ক্যান্টিনে খাবারের দাম বেশি রাখা, মোবাইল ফোনে ৬০ থেকে ৭০ জন লোক শুধু মোটা টাকা দিয়ে কথা বলার সুযোগ পান। এছাড়াও দেখা-সাক্ষাতে গেলে ভেতরে বন্দিরা ৪শ থেকে ৫শ টাকা এবং তাদের দেখতে আসা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ৫শ থেকে ১ হাজার টাকা করে ঘুস দিতে হয়। বন্দিরা আরও অভিযোগ করেন, কোনো বন্দির নিজস্ব কাপড়সহ নিত্যব্যবহার্য মালামাল দিতে গেলে ৫শ থেকে ১ হাজার টাকা দিতে হয়।

অভিযোগ আছে, কারাগারের ভেতরে মাদক ঢোকাতে সহযোগিতা করেন গেট অর্ডার সোলেমান ও সুইপার আলামিন। তবে এ বিষয়ে জেল সুপার অবগত বলে যুগান্তরের অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এসব অনিয়মের বিষয়ে নরসিংদী জেলা কারাগারের সুপার শফিউল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রতিবেদকের পরিচয় পাওয়ার পর ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে খুদে বার্তা পাঠিয়ে বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

শেয়ার করুন