২৩ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ১২:৩০:৫০ অপরাহ্ন
খুদে বার্তায় বাড়ছে ওষুধের দাম
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৭-০১-২০২৩
খুদে বার্তায় বাড়ছে ওষুধের দাম

এবার খুচরা বাজারে ওষুধের দাম বৃদ্ধিতে অভিনব পদ্ধতি বেছে নিয়েছে উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো। তারা প্রশাসনের নজর এড়িয়ে ফার্মেসি মালিকদের মুঠোফোনে খুদে বার্তা দিয়ে ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছে।

প্রায় এক বছর ধরে একাধিক প্রতিষ্ঠান বিপণন কর্মকর্তাদের মাধ্যমে দাম বাড়ালেও কিছুই জানে না সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। উলটো বলছে দাম বাড়াতে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে তারা চাপে রয়েছেন।

স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা যুগান্তরকে বলছেন, বর্তমান একজন রোগীর মোট চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশই ওষুধ ক্রয়ে খরচ হচ্ছে। এতে বিপর্যয়মূলক স্বাস্থ্য ব্যয়ের মুখোমুখি হয়ে বছরে ৮৬ লাখ মানুষ দারিদ্র্র্যসীমার নিচে নেমে যাচ্ছেন। এই ধারা বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে অপ্রত্যাশিত রোগব্যাধি ও মৃত্যু বাড়বে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এমনিতেই নিত্যপণ্যের চড়া দামের জেরে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস। জুলাইয়ে জীবন-রক্ষাকারী অনেক ওষুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন যদি কোম্পানিগুলো ফার্মেসিতে খুদে বার্তা দিয়ে ফের দাম বাড়ায়, আর প্রশাসন যদি না জানে সেটা অযৌক্তিক। দাম বাড়ানোর আগে অবশ্যই অনুমতি নিতে হবে। নিয়মবহির্ভূত দাম বাড়ানো হলে ন্যায়সঙ্গত হবে না। আকস্মিক দাম বাড়ালে অনেক রোগী ওষুধ কিনতে পারবে না। আর ডোজ সম্পূর্ণ না করলে শরীরে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক ও মুখপাত্র আইয়ুব হোসেন যুগান্তরকে বলেন, কোম্পানিগুলো খুদে বার্তা দিয়ে দাম বাড়াচ্ছে বিষয়টা তাদের জানা নেই। মোড়কের গায়ের মূল্যের বাইরে বেশি দামে কেউ বিক্রি করতে পারবে না। যে ওষুধ মার্কেটে চলে গেছে এসএমএস দিয়ে সেগুলোর দাম বাড়ানোর এখতিয়ার কোম্পানির নেই। এরকম কোনো তথ্য তাদের কেউ জানায়নি। অধিদপ্তর থেকে নির্ধারণ করা নতুন মূল্য প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকবে। তারপরও কেউ নিয়মের ব্যত্যয় করলে, কারও বিরুদ্ধে সঠিক তথ্য পেলে, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ওষুধ মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের মহাসচিব এসএম শফিউজ্জামান দাবি করেন, দাম বাড়ানোর ক্ষমতা তাদের নেই। আবেদন সাপেক্ষে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর যাচাই করে সিদ্ধান্ত দেয়। তবে বিশ্ববাজারে কাঁচামাল, প্যাকেজিং ম্যাটারিয়াল, পরিবহণ ও ডিস্ট্রিবিউশন ব্যয়, ডলারের বিনিময় মূল্য, মুদ্রানীতিসহ নানা কারণ দেখিয়ে ফার্মেসিগুলো ওষুধ চড়া দামে বিক্রি করছে। আমরা চাই যারাই বেশি দামে বিক্রি করুক সেটা যেন ঔষধ প্রশাসনকে জানিয়ে কর্নে।

জানা যায়, গত বছরের ৩০ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুষ্ঠিত ওষুধের মূল্য নির্ধারণ কমিটির ৫৮তম সভায় প্রাইস ফিক্সেশন পলিসি অনুসারে ২০টি জেনেরিকের ৫৩টি ওষুধের পুনর্নির্ধারিত দাম অনুমোদন হয়। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে বলা হয়, কাঁচামালের মূল্য বাড়ায় এর সঙ্গে সমন্বয় করে দাম কিছুটা আপডেট করা হয়েছে।

এদিকে যুগান্তরের সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানী ও বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় প্রায় এক বছর ধরে অনেক কোম্পানি ইচ্ছেমতো দামে ওষুধ বাজারজাত করছে। ফার্মেসি মালিকদের মুঠোফোনে এসএমএস ও হোটসঅ্যাপের মাধ্যমে বাড়তি মূল্য নির্ধারণ করে দিচ্ছে। মূল্যবৃদ্ধির খুদে বার্তা প্রাপ্তির তালিকায় ফুটপাত ঘেঁষে গড়ে ওঠা নামকাওয়াস্তে ফার্মেসিও বাদ যাচ্ছে না।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর মোহাম্মাদপুরের ‘জাহেদা ফার্মেসি’র মালিক সজল আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, গত কয়েক মাস ধরে বেশ কয়েকটি কোম্পানি মূল্যবৃদ্ধির জন্য খুদে বার্তা পাঠিয়েছে। ডিসেম্বরে রেনেটা লিমিটেডের বিপণন কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের স্বাক্ষর সংবলিত বার্তা পাঠান। সেখানে ওষুধের কোড নম্বর দিয়ে দাম বাড়াতে বলেছে।

যেমন; ক্যালসিয়ামের প্রতি পিস ‘ক্যালসিন-ডি’ ট্যাবলেট ৭ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮ টাকায় বিক্রি করতে বলা হয়েছে। বমি বন্ধের ডমিরেন ‘এফসি ট্যাব’ ১০-এমজি প্রতি পিস ৩ টাকা থেকে সাড়ে ৩ টাকা করা হয়েছে। ঠান্ডা ও এলার্জির চিকিৎসায় ৫০ মিলির ‘ফেনাডিন সাসপেনশন’ সিরাপ ৪৮ থেকে ৫৫ টাকা করা হয়েছে। রেনেটা কোম্পানি এসএমএস দিয়ে ৩৮টি ওষুধের দাম বাড়িয়েছে।

মোহাম্মাদপুরে সোহাগ ফার্মেসির মালিক সোহাগ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, রেডিয়েন্ট ফার্মার একজন বিপণন কর্মকর্তা তাকে খুদে বার্তা পাঠিয়েছেন। পাঠানো নতুন তালিকায় বাত-ব্যথার চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রতি পিস কার্টিকেয়ার ট্যাবলেটের দাম ১৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২১ টাকায় বিক্রি করতে বলা হয়েছে। একই রোগের জন্য এই কোম্পানির প্রতি পিস ‘কার্টিকেয়ার ম্যাক্স’ ট্যাবলেটের দাম ২০ টাকার পরিবর্তে ২২ টাকা হয়েছে। প্রতি পিস ‘কার্টিকেয়ার টিএস’ ট্যাবলেট ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া ক্যালসিয়ামের প্রতি পিস ‘কোরাল-ডি’ ট্যাবলেট ১১ থেকে ১২ টাকা করা হয়েছে।

বুধবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের একজন ফার্মাসিস্ট যুগান্তর প্রতিনিধিকে মুঠোফোনে কোম্পানির খুদে বার্তার ছবি পাঠান। সেখানে দেখা যায়, ২৪ ডিসেম্বর নুভিস্তা ফার্মার বিপণন কর্মকর্তারা খুদে বার্তা পাঠিয়েছেন। বার্তায় রক্তপাত বন্ধের ‘ট্রাকসিল’ ৫০০ এমজি ক্যাপসুল সাড়ে ২২ টাকার পরিবর্তে ২৫ টাকা হয়েছে। মেয়েদের জন্মবিরতিকরণ পিল লাইনেস ১৩০ থেকে বাড়িয়ে ১৪৩ টাকায় বিক্রির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

সাভার সেনানিবাস এলাকার জামান মেডিকেল হলের মালিক যুগান্তরকে বলেন, একমি কোম্পানি থেকে খুদে বার্তা দিয়ে জ্বরের ‘ফাস্ট’ ৬০ মিলি সিরাপ ২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৫ টাকা করেছে। চোখের ‘আইমক্স’ ড্রপ ১১৫ থেকে বাড়িয়ে ১৪০ টাকা করেছে। প্রতি পিস অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ ‘ফেমিক্লাভ’ ২৫০ এমজি ট্যাবলেট ৩০ থেকে ৩৫ টাকা, প্রতি পিস ফেমিক্লাভ ৫০০ এমজি (অ্যান্টিবায়োটিক) ট্যাবলেট ৫০ থেকে ৫৫ টাকা করেছে। উচ্চ রক্তচাপের ওরবাপিন ৫/৪০’ ওষুধ ১৬ থেকে ১৯ টাকা, ব্যথার চিকিৎসার ‘ন্যাপ্রো প্লাস’ ৫০০ এমজি ৯ টাকা থেকে ১২ টাকা ৬৫ পয়সা, ব্যথা উপশমের ‘নিউগালিন-৭৫’ ট্যাবলেট প্রতি পিস ১৪ থেকে ১৮ টাকা ৪৫ পয়সা, মাথা ঠান্ডা রাখার ওষুধ ‘লিমবিক্স’ ৫ টাকা থেকে ৮ টাকা, ঘুমের ট্যাবলেট টেনিল-৩ পাঁচ টাকা থেকে ৭ টাকা করা হয়েছে। প্রতি পিস ক্যালসিয়ামের ‘কোরালেক্স’ ট্যাবলেট ১০ থেকে ১১ টাকা করেছে।

এরিস্টোফার্মার তৈরি কোষ্ঠকাঠিন্য চিকিৎসায় ব্যবহৃত ১০০ মিলির ‘এভোল্যাক’ সিরাপ ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কদের নাকের ‘আফরিন’ ড্রপ ৪৫ থেকে ৫০ টাকা হয়েছে। গর্ভবতীদের বমি বন্ধে ‘একলিস প্লাস’ ট্যাবলেট প্রতি পিস ৩ থেকে সাড়ে ৩ টাকা। অপসোনিনের ৫০ মিলি ‘মেট্রিল’ সিরাপ ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। বেক্সিমকোর শিশুদের কাশির ১০০ মিলি ‘টোফেন’ সিরাপ ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা।

বুধবার ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, দাম বাড়াতে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তারা চাপে রয়েছেন। করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ডলার সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে কাঁচামাল আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে। তাই ওষুধের দাম বাড়ানো নিয়ে চাপ রয়েছেন।

শেয়ার করুন