২৮ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১১:৫২:৫৮ অপরাহ্ন
পুলিশের অপরাধ তদন্তে দ্বৈতনীতি, নিম্নপর্যায়ে সাজা হলেও পার পাচ্ছেন উচ্চপদস্থরা
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৮-০২-২০২৩
পুলিশের অপরাধ তদন্তে দ্বৈতনীতি, নিম্নপর্যায়ে সাজা হলেও পার পাচ্ছেন উচ্চপদস্থরা

পুলিশের মাঠ পর্যায়ে কর্মরতদের অপরাধের শাস্তির ব্যাপারে কঠোর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এর উলটো চিত্র উচ্চপর্যায়ে। কনস্টেবল থেকে পরিদর্শক পদমর্যাদার পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু এএসপি থেকে ওপরের পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ আছে। 

কোনো কোনো ক্ষেত্রে তদন্তই হয় না। তদন্ত কমিটি হলেও প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না। আবার প্রতিবেদনে শাস্তির সুপারিশ করা হলেও তা বাস্তবায়িত হয় না। এসব কারণে পার পেয়ে যাচ্ছেন উচ্চপদস্থরা। বিষয়টিকে দ্বৈতনীতি হিসাবে উল্লেখ করেছেন বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত পুলিশ সদস্যরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পুলিশের পোশাক পরে টিকটকে ভিডিও আপলোড করায় গত ৬ অক্টোবর ১৩ কনস্টেবলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। 

কিন্তু বরিশালে কর্মরত অবস্থায় প্রায় দুই বছর আগে পুলিশের পোশাক পরে টিকটকে ভিডিও আপলোড করে ভাইরাল হন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নাইমুল হক। তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাকে এরই মধ্যে এসপি পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে নাইমুল হকের ব্যক্তিগত এবং সরকারি নম্বরে বারবার ফোন করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে ডিএমপির সাবেক কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নোংরামি ঠেকানোর দায়িত্ব পুলিশ সদস্যদের। তারা যদি নোংরামি করে, তাহলে তা ঠেকাবে কে?’ 

তিনি বলেন, আমি ডিএমপি কমিশনার থাকাকালে ১৩ ‘টিকটকার’ পুলিশ কনস্টেবলের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করেছিলাম। তারা যখন টিকটক ভিডিও আপলোড করেছিল, তখন ডিএমপিতে কর্মরত ছিল। পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের বদলি করা হয়।

কয়েক বছর আগে সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থাকার সময় মোকতার হোসেন এবং নারী কনস্টেবলের অনৈতিক সম্পর্কের অডিও ভাইরাল হয়। উইম্যান পুলিশ নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে তৎকালীন আইজিপির কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু তার কোনো শাস্তি হয়নি। উপরন্তু পদোন্নতি পেয়ে ভোলার পুলিশ সুপার (এসপি) হন। বর্তমানে তিনি অতিরিক্ত ডিআইজি হিসাবে সিআইডিতে কর্মরত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত ডিআইজি মোকতার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ওটা ফেক অডিও ছিল। তাই আমার বিরুদ্ধে ওই ঘটনায় তদন্তই হয়নি। অন্য ঘটনায় তদন্ত হয়েছিল। কিন্তু অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।

বরিশাল স্টিমারঘাট পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আবুল বাশারের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ১৫ অক্টোবর গ্রেফতার করা হয়। অন্যদিকে নারী পুলিশ পরিদর্শকের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগে পিবিআই এসপি মোক্তার হোসেনের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের আগস্টে মামলা হয়। ওই মামলায় চার্জশিটও হয়েছে। কিন্তু তাকে গ্রেফতার করা হয়নি। 

এ বিষয়ে বারবার যোগাযোগ করেও এসপি মোক্তার হোসেনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে পুলিশের অতিরিক্ত আইজি ও পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার জানান, মোক্তারের বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা এই মুহূর্তে বলতে পারব না। তবে একটা কিছু হয়েছে। তিনি এখন পিবিআই-এ নেই। পুলিশ সদর দপ্তরে ন্যস্ত আছেন।

সূত্র জানায়, একজন চিত্রনায়িকাকে নিয়ে নিজ সরকারি বাসায় ১৮ ঘণ্টা কাটান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) গোলাম সাকলায়েন। ২০২১ সালের আগস্টের ঘটনা এটি। ওই ঘটনার ভিডিও ভাইরাল হলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সাকলায়েনকে ডিবি থেকে মিরপুর পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে (পিওএম) বদলি করা হয়। এখন অতিরিক্ত এসপি হিসাবে তিনি ঝিনাইদহে কর্মরত আছেন। 

ওই ঘটনায় ডিএমপির পক্ষ থেকে সাকলায়েনের বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও আলোর মুখ দেখেনি প্রতিবেদন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোলাম সাকলায়েন যুগান্তরকে বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। তিনি বলেন, আমি পেশাগত সম্পর্কের চেয়ে মানুষের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে গুরুত্ব দিই।

এ বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন) একেএম হাফিজ আক্তার যুগান্তরকে বলেন, তদন্ত কমিটি হলেও আমার জানামতে সাকলায়েনের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কারণ, এ বিষয়ে কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি।

সূত্রমতে, ২০২০ সালের শেষের দিকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ও বাঘা যতীনের আবক্ষ ভাঙা নিয়ে বিতর্কিত মন্তুব্য করে আলোচনায় আসেন কুষ্টিয়ার তৎকালীন এসপি এসএম তানভীর আরাফাত। ওই সময় তাকে চাকরি থেকে অপসারণের দাবি ওঠে। 

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা পৌরসভা নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকালে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মহসিন হাসানের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন তিনি। এজন্য ২০২১ সালের জানুয়ারিতে হাইকোর্টে নিঃশর্ত ক্ষমাপ্রার্থনা করেন তিনি। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠলেও কোনো বিভাগীয় তদন্ত হয়েছে বলে জানা যায়নি। 

এ বিষয়ে এসপি এসএম তানভীর আরাফাত যুগান্তরকে বলেন, কুষ্টিয়ায় থাকাকালীন ঘটনায় আদালত যে আদেশ দিয়েছিলেন, যথাযথ কর্তৃপক্ষ সেটা বাস্তবায়ন করেছেন। বিষয়টি নিয়ে কোনো তদন্ত হয়নি জানিয়ে বলেন, আমি এখন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মরত আছি।

২০২১ সালে প্রশিক্ষণে গিয়ে একবেলা রোলকলে অনুপস্থিত থাকার কারণে ২১২ জন পিএসআই-এর এক বছর মেয়াদি কোর্স বাতিল করা হয়। অথচ কয়েক বছর আগে বিদেশে উচ্চশিক্ষায় গিয়ে নিজের মদপানের ভিডিও ধারণ করে ভাইরাল হয়েছিলেন বিসিএস ২৪তম ব্যাচের পুলিশ কর্মকর্তা ড. আ ক ম আক্তারুজ্জামান বসুনিয়া। 

ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখন তিনি হাইওয়ে পুলিশে এসপি হিসাবে কর্মরত। এ বিষয়ে এসপি আক্তারুজ্জামান বসুনিয়া যুগান্তরকে বলেন, অভিযোগটি আমার স্ত্রী দিয়েছিল। সেটি নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে একটি তদন্ত হয়েছে। যেহেতু আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটু ঝামেলা হয়েছিল, পরে সমঝোতা হয়ে গেছে। তদন্ত প্রতিবেদনও সেভাবে দেওয়া হয়েছে। এ কারণে আমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

কক্সবাজারে বহুল আলোচিত মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার ঘটনায় র‌্যাবের তদন্ত প্রতিবেদনে কক্সবাজারের তৎকালীন এসপি এবিএম মাসুদ হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি। তিনি এখন রাজশাহী জেলার এসপি হিসাবে কর্মরত। 

এ ব্যাপারে কথা বলতে মাসুদ হোসেনের সরকারি মোবাইল নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে তার ব্যক্তিগত নম্বরে ফোন করা হলে বলেন, ‘আপনি ফালতু বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করছেন কেন। আপনি আমার এই নম্বর কোথায় পেলেন?’ এরপর তিনি সংযোগ কেটে দেন। 

গত জুনে নড়াইলে একজন কলেজ শিক্ষককে এসপির উপস্থিতিতে জুতার মালা পরানো হয়। বিষয়টি দেশব্যাপী ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। এসপি প্রবীর কুমার রয়ের বিচার দাবিতে মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি চলে। ঘটনাটি প্রতিহতে ব্যর্থতার অভিযোগে নড়াইল সদর থানার তখনকার ওসি মোহাম্মদ শওকত কবীরকে প্রত্যাহার করা হয়। ব্যবস্থা নেওয়া হয় নিচের পর্যায়ের আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। এসপির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। 

এরই মধ্যে তিনি অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। তিনি এখন চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি অফিসে অতিরিক্ত ডিআইজি পদে কর্মরত। এ বিষয়ে নড়াইলের তৎকালীন এসপি প্রবীর কুমার রায় (বর্তমানে অতিরিক্ত ডিআইজি) যুগান্তরকে বলেন, ঘটনাটি বেশ আগের। তাই কার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা ভালোভাবে বলতে পারব না। তবে যেসব পুলিশ সদস্যের দায়িত্বে অবহেলা ছিল, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি মঈনুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। ওই রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. ইকবাল যুগান্তরকে বলেন, যখন ঘটনাটি ঘটেছে, তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। আমি পরে দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। তাই এ নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে পারছি না।

১১ বছর আগে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশে (ডিবি) কর্মরত থাকা অবস্থায় একজন উপকমিশনারের বিরুদ্ধে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ৮৬ লাখ টাকা ঘুস নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। ওই দৃশ্য ধরা পড়ে সিসি ক্যামেরার ফুটেজে। অভিযোগের মুখে তাকে ডিবি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তদন্ত হলেও শাস্তির মুখে পড়তে হয়নি তাকে। উপরন্তু প্রাইজ পোস্টিং হিসাবে বদলি করা হয় একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলার এসপি হিসাবে। এখন তিনি একটি মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার।

বিভিন্ন সময়ে নানা কর্মকাণ্ডে আরও অন্তত অর্ধশত পদস্থ কর্মকর্তা সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো শান্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন এসএম আক্তারুজ্জামান, মফিজুর রহমান, জায়েদুল আলম, আলী আশরাফ ভূঁঞা, এসএম মুরাদ আলী, হাসানুজ্জামান, নাইমা সুলতানা, রহিমা আক্তার লাকি, মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ফারুকী, গোলাম রব্বানী, হারুন অর রশিদ (অতিরিক্ত উপকমিশনার) প্রমুখ।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজি (প্রশাসন) কামরুল আহসান যুগান্তরকে বলেন, পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগের তদন্তে দ্বৈতনীতি অনুসরণ করা হয় না। সবার বিরুদ্ধেই আমরা তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিই। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে যৌক্তিক কারণেই তদন্তে সময় লাগে। উচ্চপদস্থ যেসব পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান, এর সবাই একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে।

শেয়ার করুন