২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ০২:২৫:৩২ পূর্বাহ্ন
দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে দুদকের স্ট্রাইকিং ফোর্স
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৯-০৪-২০২৩
দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে দুদকের স্ট্রাইকিং ফোর্স

দুর্নীতিবিরোধী অভিযান জোরদারের লক্ষ্যে এবার স্ট্রাইকিং ফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুর্নীতিবাজদের তাৎক্ষণিকভাবে আইনের আওতায় আনতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর অংশ হিসাবে সংস্থাটির গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালকের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের একটি টিম গঠন করা হয়েছে।

এই টিমের সদস্যরা রুটিন বা দৈনন্দিন কার্যক্রমের বাইরে থাকবেন। তারা শুধু বিশেষ বা বড় ধরনের দুর্নীতির অনুসন্ধানের তথ্য সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত থাকবেন। অর্থ পাচারে জড়িতদের বিষয়ে গোপনে তথ্য সংগ্রহ করবে এ টিম।

এছাড়াও তাদের নজরে থাকবে জনগুরুত্বপূর্ণ, বহুল আলোচিত এবং স্পর্শকাতর দুর্নীতির ঘটনা। অপরদিকে সরকারি অফিস-আদালত এমনকি অফিস সময়ের বাইরে অন্য কোথাও ঘুস লেনদেনের ঘটনা হাতেনাতে ধরতে ছদ্মবেশে কাজ করবেন বিশেষ টিমের সদস্যরা। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

মোহাম্মদ মঈনউদ্দিন আব্দুল্লার নেতৃত্বাধীন কমিশন এই প্রথম স্ট্রাইকিং ফোর্স বা বিশেষ কমিটি গঠনের মাধ্যমে উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতি ধরতে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলো। দুর্নীতিবিরোধী অভিযান জোরদারের অংশ হিসাবে ১৮ এপ্রিল কমিশন সভায় এ বিষয়ে জনগুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে জানা গেছে।

কমিশন সূত্র জানায়, ওই দিনের সভায় আলোচ্যসূচির মধ্যে স্পর্শকাতর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার জন্য বিশেষ টিম বা স্ট্রাইকিং ফোর্স গঠনের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। সভায় জানানো হয়, দুর্নীতি প্রতিরোধ কার্যক্রম আরও বেগবান করতে হবে। এ লক্ষ্যে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করা বিশেষ প্রয়োজন। দুর্নীতিবাজদের তাৎক্ষণিক আইনের আওতায় আনার জন্য কমিশনে সার্বক্ষণিক স্ট্রাইকিং ফোর্স প্রস্তুত রাখা দরকার। কমিশনের বিশেষ তদন্ত বিভাগের অধীন দক্ষ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি বিশেষ টিম এ লক্ষ্যে মাঠপর্যায়ে কাজ করবে। ওই টিমের কর্মকর্তাদের সাধারণ অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজে নিয়োজিত রাখা হবে না। কমিশনে সর্বসম্মতভাবে স্ট্রাইকিং ফোর্স বা বিশেষ টিম গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

জানা গেছে, ওই বিশেষ টিমের প্রধান করা হয়েছে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের পরিচালক আব্দুল্লা আল জাহিদকে। এছাড়া মানি লন্ডারিং বিভাগের পরিচালক গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরীকে সমন্বয়ক হিসাবে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন-উপ-পরিচালক ফারুক আহমেদ (বিমা ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান) উপ-পরিচালক সেলিনা আখতার মনি (বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত-৩), উপ-পরিচালক নাজমুল হোসাইন (মানি লন্ডারিং), উপ-পরিচালক মো. তানজির হাসিব সরকার, সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নেয়ামূল আহসান গাজী (বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত শাখা-২) এবং সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নূর আলম সিদ্দিকী (মানি লন্ডারিং)।

দুদক সূত্রে আরও জানা যায়, এ ৮ সদস্যের বাইরেও স্পর্শকাতর ও উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতি ধরতে কমিটি প্রয়োজনীয় সংখ্যক আরও কর্মকর্তাদের কো-অপ্ট করতে পারবে।

দুদকের এই বিশেষ উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কমিশনার জহরুল হক বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, আমরা সর্বতোভাবে চেষ্টা করছি সমাজকে দুর্নীতি মুক্ত করতে। চোখের সামনে যেসব বড় বড় দুর্নীতির ঘটনা ঘটছে সেগুলোকে বের করে নিয়ে আসতে। এ লক্ষ্যে বিশেষ টিম গঠনে কমিশন সভায় সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

তিনি জানান, ওই টিমকে সাধারণ অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজের বাইরে রাখা হবে। তারা শুধু বিশেষ বিশেষ জনগুরুত্বপূর্ণ দুর্নীতি নিয়ে কাজ করবেন। কমিশন এজন্য চেষ্টা চালিয়ে যাবে।

প্রসঙ্গত, এর আগে জরুরি সরকারের সময়ে এ ধরনের স্ট্রাইকিং ফোর্স গঠন করেছিল দুদক। এরপর গোলাম রহমান কমিশনের সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ধরতে টিম গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পরে ইকবাল মাহমুদ কমিশনের সময়ে ১১টি প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল সরকারি সেবা খাতে দুর্নীতি দমনে কাজ করা। প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত করা। ওই টিম তিতাস, ওয়াসা, ডেসা, বিটিসিএল, রাজউক, ডাক বিভাগ, সিভিল এভিয়েশন ও বিমান, বিআরটিএ, বিআইডব্লিউটিএ, বিআরটিসি, সিটি করপোরেশন, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত, স্থানীয় সরকার বিভাগসহ ২৫টি দপ্তরে দুর্নীতির বিষয়ে সরেজমিন অনুসন্ধান করে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করে।

প্রতিটি কমিটি ওইসব দপ্তরে কী ধরনের দুর্নীতি হয়, কীভাবে সে দুর্নীতি রোধ করা যায়-সেই সুপারিশ কমিশনে দাখিল করে। পরে কমিশন প্রতিটি সুপারিশ স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর কাছে দাখিল করে। সঙ্গে একটি চিঠিও দেওয়া হয়। যাতে বলা হয়, দুদক টিমের মাধ্যমে উঠে আসা দুর্নীতি রোধ করা না গেলে মানুষ আরও বেশি ক্ষতির শিকার হবেন। রাষ্ট্রের সেবা থেকে জনগণ বঞ্চিত হবেন। কমিশন থেকে মন্ত্রীদের অনুরোধ করা হয়, তারা যেন স্ব স্ব মন্ত্রণালয় ও তার অধীন দপ্তর ও অধিদপ্তরের দুর্নীতি রোধকল্পে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন।

কিন্তু কমিশনের কোনো সুপারিশই আমলে নেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে। যে কারণে কমিশনের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির কাছে দেওয়া বার্ষিক প্রতিবেদনে সেসব সুপারিশ পুনরায় তুলে ধরে রাষ্ট্র এবং জনগণকে দুর্নীতির কবল থেকে রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়।

দুদকের সর্বশেষ ২০২২ সালের প্রতিবেদনেও রাষ্ট্রপতির কাছে অনেক সুপারিশ পেশ করা হয়। এতে বলা হয়, ঘুস-দুর্নীতির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উভয় পক্ষ সুবিধাভোগী। বঞ্চিত হয় শুধু রাষ্ট্র এবং সমাজ। তাই কমিশন দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, সংবিধানে ঘোষিত ম্যান্ডেট অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ ভোগ করতে না দেওয়ার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

দুদকের শীর্ষপর্যায়ের একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতার কারণে অনেক ক্ষেত্রে দুদক জনগুরুত্বপূর্ণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারে না। কিন্তু নতুন যে ফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তাদের সব ধরনের দুর্নীতি ধরতে ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। মুখ দেখে নয় বরং দুর্নীতির গুরুত্ব বুঝে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।

তিনি আরও জানান, এই টিমের সদস্যরা দুর্নীতির তথ্য বের করে আনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত কৌশলী ভূমিকা নেবেন। বাছাইকৃত উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতির ফাইলও তাদের হাতে থাকবে। তারা সময়ে সময়ে কমিশনের কাছে আপডেট তথ্য জানাবে। টিমের সদস্যরা দুদকের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের সহযোগিতাও নিতে পারবেন। ইতোমধ্যে দুদকের ল্যাবে দুর্নীতিবাজদের অনুসরণের বিভিন্ন যন্ত্র বসানো হয়েছে। তারা ওই ল্যাবের টেকনোলজি ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির গতিবিধিও অনুসরণ করতে পারবেন।

শেয়ার করুন