রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে দেশে শুরু হয় ডলার সংকট। ফলে টাকার বিপরীতে বেড়ে যায় ডলারের দাম। এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে। এতে বেড়ে যায় আমদানিযোগ্য পণ্যের দামও, যা অস্থিরতা সৃষ্টি করে পণ্যের বাজারে। এ অস্থিরতা মোকাবিলায় এবং আমদানি-রফতানির ভারসাম্য ঠিক রাখতে এবার প্রতিবাণিজ্যের দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশ। এমন তথ্য জানিয়েছেন আমদানি-রফতানি নিয়ন্ত্রকের দফতর, চট্টগ্রাম কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রক আবদুর রহিম। মঙ্গলবার দুপুরে সময়ের আলোকে এ তথ্য জানান তিনি।
আবদুর রহিম বলেন, প্রতিবাণিজ্য শুরু হলে দেশের ব্যবসায়ীদের আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে কোনো রকম এলসি খোলার প্রয়োজন হবে না। বিদেশি মুদ্রায় একটি বিশেষ হিসাব (স্ক্রু অ্যাকাউন্ট) পরিচালনার মাধ্যমে আমদানি ও রফতানি কার্যক্রম নিষ্পত্তির সুযোগ পাবেন ব্যবসায়ীরা। এ সংক্রান্ত একটি খসড়া নীতিমালা তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তিনি জানান, দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের সিংহভাগই এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) নির্ভর। অথচ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এলসির ব্যবহার প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। উন্নয়নশীল দেশেও এলসির ব্যবহার কমে আসছে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এ পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের বৈদেশিক মুদ্রানীতিতে যথাযথ পরিবর্তন আনার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।
এলসি ছাড়া আমদানি-রফতানির এ ধরনের কার্যক্রম পার্শবর্তী দেশ ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই চালু রয়েছে। এ পদ্ধতিতে আমদানি পণ্যের মূল্য দ্বারা রফতানি পণ্যের মূল্য এবং রফতানি পণ্যের মূল্য দ্বারা আমদানি পণ্যের মূল্য সমন্বয় করার সুযোগ পাবেন ব্যবসায়ীরা। অর্থাৎ কোনো ব্যবসায়ীর আমদানি পেমেন্ট দেওয়া হবে তারই রফতানির বিপরীতে পাওয়া বৈদেশিক আয় দিয়ে।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংক, চট্টগ্রাম কার্যালয়ের নির্বাহী পরিচালক নজরুল ইসলামও। তিনি বলেন, ব্যাংকিং ব্যবস্থা সুদৃঢ় নয় কিংবা ব্যাংকিং লেনদেনে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা রয়েছে এমন দেশগুলোতে ব্যবসা সম্প্রসারণে প্রতিবাণিজ্য ব্যবস্থায় বাণিজ্য পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়।
এ ক্ষেত্রে দেশের স্থানীয় পক্ষ ওই দেশের সংশ্লিষ্ট পক্ষের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম হতে সৃষ্ট পরিশোধ নিষ্পত্তিতে প্রয়োজনীয় সহায়কের ভূমিকা পালন করে থাকে। এ ক্ষেত্রে প্রথম ধাপে আমদানি দিয়ে প্রতিবাণিজ্য লেনদেন পরিচালনার অনুমতি দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, এ ধরনের বাণিজ্যের অনুমতি দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো রফতানি আয়ের প্রবাহ বৃদ্ধি করা। তবে ঢালাওভাবে এ ধরনের বাণিজ্যের সুযোগ দেওয়া হবে না। বরং যেসব দেশে নরমাল ব্যাংকিং ব্যবস্থা নেই বা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় পিছিয়ে রয়েছে, সেসব দেশে এ ব্যবস্থায় বাণিজ্য করার অনুমতি দেওয়া হবে।
নীতিমালায় যা আছে : রফতানি নীতি ২০২১-২৪-এর দ্বিতীয় অধ্যায়ের বাস্তবায়ন কৌশল অংশের ২.৩.২৩ নং অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে অধিকতর বাণিজ্যবান্ধব ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং মার্চেন্ডিং ট্রেড ও প্রতিবাণিজ্য বিষয়ে প্রয়োজনীয় নীতিমালা ঘোষণার কথা বলা আছে। এরই মধ্যে মার্চেন্ডিং ট্রেড বিষয়ে নীতিমালা জারি করা হয়েছে। এরপর প্রতিবাণিজ্য সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়।
নীতিমালায় রফতানি নীতিতে প্রতিবাণিজ্যের সংজ্ঞায় উদ্ধৃতি তুলে ধরা হয়েছে। মূলত রফতানি নীতির দ্বিতীয় অধ্যায়ে প্রতিবাণিজ্যের সংজ্ঞায় বলা আছে, ‘বাংলাদেশে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য দ্বারা বাংলাদেশ থেকে রফতানিকৃত পণ্যের মূল্য কিংবা বাংলাদেশ থেকে রফতানিকৃত পণ্যের মূল্য দ্বারা বাংলাদেশে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য সমন্বয় ব্যবস্থাকে বোঝাবে।’ এ ব্যবস্থায় দুটি পদ্ধতিতে বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্পাদিত হয়ে থাকে। প্রথমত, বাংলাদেশের আমদানি দিয়ে লেনদেন শুরু হতে পারে। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের রফতানি দিয়ে লেনদেন শুরু হতে পারে।
এ বিষয়ে বিজিএমইএর প্রথম সিনিয়র সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ ধরনের পদক্ষেপকে আমরা সমর্থন করি। এর মাধ্যমে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য প্রমোট করার জন্য তারা যে সর্বদা সহযোগিতা করে, এটি তার একটি প্রমাণ। তিনি বলেন, সিঙ্গাপুর, হংকংসহ বিভিন্ন দেশ এ ধরনের ট্রেড করে প্রচুর উন্নতি করেছে। আমি মনে করি, ব্যবসায়ীরা এ ধরনের সুযোগ পেলে বিদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
যেভাবে পরিচালিত হবে লেনদেন : নীতিমালার তথ্য মতে, আমদানির ক্ষেত্রে বিদেশি প্রতিসঙ্গীর নামে এ দেশে বিনিময়যোগ্য বৈদেশিক মুদ্রায় একটি স্ক্রু অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করবে, যাতে স্থানীয় আমদানিকারক প্রচলিত আমদানি পদ্ধতি অনুসরণ করে আমদানি মূল্য বিনিময়যোগ্য বৈদেশিক মুদ্রায় স্থানীয় ব্যাংকিং চ্যানেলে ওই হিসাবে জমা করবে। জমা অর্থের স্থিতি দ্বারা এ দেশ থেকে রফতানির বিপরীতে রফতানিকারক স্থানীয় ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রফতানি মূল্য পাবে। বিদেশি পক্ষের সঙ্গে সমঝোতা অনুযায়ী কমিশন ও সেবা মাসুল স্থানীয় পক্ষের প্রাপ্য হবে, যা স্ক্রু অ্যাকাউন্ট থেকে নগদায়ন করে স্থানীয় পক্ষের টাকা হিসেবে জমা হবে। স্থানীয়ভাবে পরিচালিত স্ক্রু অ্যাকাউন্টের স্থিতির ওপর সুদ প্রযোজ্য হবে না। তবে এ হিসাবের স্থিতি বাংলাদেশে পরিচালিত অন্য স্ক্রু অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা যাবে, যাতে ওই হিসাবের মাধ্যমে রফতানি আয় পরিশোধের ব্যবস্থা করা যায়।
রফতানির ক্ষেত্রে স্থানীয় পক্ষ বিদেশে বিনিময়যোগ্য বৈদেশিক মুদ্রায় স্ক্রু অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করবে। প্রতিবাণিজ্য পদ্ধতির আওতায় এ দেশ থেকে রফতানি করা পণ্যের মূল্য ওই হিসাবে জমা হবে, যা দিয়ে এ দেশের আমদানির দায়সহ প্রতিসঙ্গীর কমিশন ও সেবা মাসুল পরিশোধ হবে। তবে রফতানি দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে স্থানীয় পক্ষ বিদেশে বিনিময়যোগ্য বৈদেশিক মুদ্রায় স্ক্রু অ্যাকাউন্ট স্থাপনের আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনের গ্রহণের বাধ্যবাধকতা রাখা হবে।
ঝুঁকি মোকাবিলায় করণীয় : বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা বলছেন, প্রথম ধাপে রফতানি দিয়ে লেনদেন আমদানি দিয়ে লেনদেন শুরুর চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। কেননা যথাসময়ে সমপরিমাণ আমদানির অবর্তমানে রফতানি মূল্য সমন্বয় করতে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হতে পারে। তাই খসড়া নীতিমালায় আমদানি দিয়ে লেনদেন শুরুর ব্যবস্থা রেখে পরিচালন বিধি সন্নিবেশন করা হয়েছে বলে জানান ব্যাংক কর্মকর্তারা।
বিআইবিএম গবেষণা কর্মকর্তার মতামত : বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) গবেষণা কর্মকর্তা মোহাম্মদ রায়হানুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ এ মুহূর্তে প্রতিবাণিজ্যে গেলে অন্য দেশ হয়তো ভাববে আমাদের এখন বৈদেশিক মুদ্রা কম আছে। তাই সে কিছু বাড়তি সুবিধা নিতে চাইতে পারে। কারণ যার দরকষাকষির শক্তি দুর্বল তার তো সুবিধা দিতেই হবে।
এ ধরনের প্রতিবাণিজ্যেও অর্থ পাচারসহ অন্যান্য ঝুঁকি থাকে। বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই অর্থ পাচারের আশঙ্কা থাকে। আমদানিতে বেশি মূল্য ও রফতানিতে কম মূল্য দেখিয়ে অর্থ পাচার করা হয়। এ ক্ষেত্রে পণ্যের মূল্য যথাযথভাবে যাচাই করার জন্য ব্যাংকারদেরই আসল দায়িত্বটা নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমাদের এক্সপোর্ট মার্কেট দিন দিন বায়ার্স মার্কেট হয়ে যাচ্ছে। ফলে বায়ার্সরা কম মূল্য দিতে এলসির পরিবর্তে চুক্তিতে আসতে চায়। কারণ এলসিতে খরচ বেশি। অন্যদিকে আমাদের ইমপোর্ট মার্কেট দিন দিন হয়ে যাচ্ছে সেলার্স মার্কেট। ফলে সেলার্সের উদ্দেশ্য থাকে ফরেন গ্যারান্টি দেওয়া। আর ফরেন গ্যারান্টি নিশ্চিত হয় এলসিতেই। সে জন্য আমাদের ইমপোর্টের ক্ষেত্রে বিদেশিরা বলে এলসিতে আসতে, আবার রফতানির ক্ষেত্রে বলে কন্ট্রাক্টে যেতে। ফলে আমরা দুদিক থেকেই মার খাচ্ছি।