রাজশাহী সিটি নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। সকাল আটটার আগেই কেন্দ্রে কেন্দ্রে নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিলো চোখে পড়ার মতো। এবার মেয়র পদে চারজন প্রার্থী ছাড়াও ১১২ জন কাউন্সিলর ও ৪৬ জন সংরক্ষিত নারী আসনের কাউন্সিলর প্রার্থী রয়েছেন। তবে মেয়র পদেরএকজন প্রাথী সরে দাঁড়িয়েছেন। আর নগরীর ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। অন্য ২৯টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ভোট হচ্ছে। এছাড়া ৩০টি ওয়ার্ডের জন্য সংরক্ষিত ১০টি নারী আসনেও প্রচার-প্রচারণা জমে উঠেছিল।
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ভোটকেন্দ্রে একজন প্রিসাইডিং কর্মকর্তার পাশাপাশি ১০ জন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করবেন। ভোটকেন্দ্রে থাকবেন মোট ৩ হাজার ৬১৪ জন কর্মকর্তা। নির্বাচনের দিন ১০ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভোটের মাঠে থাকবেন। এছাড়া প্রতীক বরাদ্দের দিন থেকেই জেলা প্রশাসনের ১০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করছেন। তারাও ভোটের দিন দায়িত্ব পালন করবেন। এর পাশাপাশি ভোটকেন্দ্রে থাকবে আনসার ও পুলিশ। আর স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে থাকবে র্যাব ও বিজিবি। মঙ্গলবার সকালে পুলিশ লাইন্সে পুলিশ এবং র্যাব-৫ এর সদর দপ্তরে র্যাবের প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। এরপর পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা ভোটের মাঠে বেরিয়ে পড়েন।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের কমিশনার আনিসুর রহমান জানান, ভোটকেন্দ্র এবং শহরের নিরাপত্তায় নগরজুড়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। বিজিবির রাজশাহীর সেক্টর কমান্ডার কর্নেল ইমরান জানান, আজ ভোটের দিন ১২ প্লাটুন বিজিবি মাঠে থাকবে। প্রতি প্লাটুনে থাকবেন ২০ জন করে বিজিবি সদস্য। আর র্যাব-৫ এর রাজশাহীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিয়াজ শাহরিয়ার জানান, দায়িত্বে থাকবে ২৫০ র্যাব সদস্য।
নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘এ পর্যন্ত মেয়র পদের প্রার্থীদের মধ্যে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা ঘটেনি। তবে কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে প্রচার চলাকালে টুকটাক বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। সার্বিক মূল্যায়নে ভোটের পরিবেশ খুব শান্তিপূর্ণ। এভাবেই শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ শেষ হবে। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের লক্ষ্যে কমিশন কাজ করে যাচ্ছে।’
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের আয়তন ৯৬ দশমিক ৭২ বর্গকিলোমিটার। এই সিটিতে ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৫১ হাজার ৯৮২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৭১ হাজার ১৬৭ জন। আর নারী ভোটার ১ লাখ ৮০ হাজার ৮০৯ জন। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন ৬ জন। এই নির্বাচনে তৃতীয় লিঙ্গের একজন নারী কাউন্সিলর পদে লড়ছেন। রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) নির্বাচনের ভোটকেন্দ্রগুলোতে নির্বাচনী সরঞ্জাম পাঠানো শুরু হয়। মঙ্গলবার (২০ জুন) বেলা ১১টা থেকে রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ থেকে এই কার্যক্রম শুরু হয়। চলে বিকেল পর্যন্ত। প্রিজাইডিং কর্মকর্তা, আনসার সদস্য এবং ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা ইভিএমসহ অন্যান্য সরঞ্জাম কেন্দ্রে কেন্দ্রে নিয়ে যাচ্ছেন।
আজ বুধবার সিটি নির্বাচনের ভোটগ্রহণ করা হবে। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এ জন্য আগের দিন ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটগ্রহণের জন্য পাঠানো হচ্ছে নির্বাচনী সরঞ্জাম। এবার ১৫৫টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ করা হবে। এ জন্য প্রয়োজন প্রায় হবে প্রায় ১ হাজার ১০০টি ইভিএম মেশিন। তবে পাঠানো হচ্ছে ১ হাজার ৭০০টি। কোন ইভিএমে ত্রুটি দেখা গেলে অন্যটি ব্যবহারের সুযোগ থাকবে।
নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন জানান, নির্বাচনের দিন ইভিএমে কোথাও কোন সমস্যা হলে কারিগারি টিম দ্রুত গিয়ে সমস্যার সমাধান করবে। তবে ইভিএম পরিচালনায় কোন সমস্যা হবে না। কারণ, এরই মধ্যে প্রশিক্ষণ কর্মশালা করা হয়েছে। সেখানে প্রিজাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং পোলিং কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। মোট ৩ হাজার ৬১৪ জন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা ভোটগ্রহণের কাজে নিয়োজিত থাকবেন।
তিনি জানান, রাজশাহী সিটি নির্বাচনে এই প্রথমবারের মত ইভিএম ব্যবহার হবে। মোট ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ১৫৫টি। আর ভোটগ্রহণ কক্ষের সংখ্যা ১ হাজার ১৫৩টি। তবে মাত্র ৭টি ভোটকেন্দ্র বাদে ১৪৮টিই ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে নির্বাচন কমিশন। তবে সব কেন্দ্রেই থাকবে ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা। ১৫৬০টি সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে ঢাকা থেকে নির্বাচন কমিশন ভোট পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করবে।
তিনি আরও জানান, কোথাও কোনো প্রকার অনিয়ম বা অব্যবস্থাপনা হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভোটগ্রহণ চলাকালে কোনো কেন্দ্রে কেউ গোলযোগ সৃষ্টি বা সহিংসতার চেষ্টা করলে তাকে কঠোর হাতে দমন করা হবে বলেও জানান রিটার্নিং কর্মকর্তা।
অপরদিকে, রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) এলাকার ভোটার নন, এমন বহিরাগতদের নির্বাচনী এলাকা ছাড়ার আহ্বান জানিয়েছে র্যাব। পাশাপাশি শহরের বাসিন্দাদের বুধবার ভোটের দিন জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে চলাফেরার আহ্বান জানিয়েছে বাহিনীটি। নির্বাচন উপলক্ষে মঙ্গলবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ আহ্বান জানান র্যাব-৫ এর রাজশাহীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রিয়াজ শাহরিয়ার।
র্যাব-৫ সদর দপ্তরে এই প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, এই নির্বাচনে কেউ বাধা সৃষ্টি করলে অথবা সহিংসতা বা নাশকতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে র্যাব কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বহিরাগত অথবা সিটি করপোরেশন এলাকার ভোটার নন এ রকম নাগরিকদের নির্বাচনী এলাকা ত্যাগ অথবা ভোটের দিন নির্বাচন কমিশনের বিধিনিষেধ মেনে চলার জন্য র্যাবের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হচ্ছে। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার লক্ষে অনুপ্রবেশকারী কোন ব্যক্তিদের অপতৎপরতা আইন-শৃংখলা বাহিনী কঠোর ভাবে দমন করবে।
র্যাব অধিনায়ক জানান, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে বুধবার ভোর ৬টা থেকে অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি র্যাবের প্রায় ৩০০ জন সদস্য মাঠে থাকবেন। মোবাইল টিম, স্ট্রাইকিং ফোর্স, সাদা পোশাকে গোয়েন্দা এবং বোমা নিস্ক্রিয়কারী হিসেবে তারা দায়িত্ব পালন করবেন। র্যাব-৫ এর ১৫টি মোবাইল ও স্ট্রাইকিং পেট্রোল, স্ট্রাইকিং ফোর্স কমান্ডারসহ ১০টি জীপ, দুটি স্ট্রাইকিং ফোর্স রিজার্ভ টিম, সাদা পোশাকে গোয়েন্দা দল, সুপার মোবাইল মোটরসাইকেল টিম এবং অ্যাম্বুলেন্স টিম নির্বাচনের দিন দায়িত্বে থাকবে।
এছাড়া যেকোন উদ্বুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রয়নের জন্য র্যাব-৫ এর বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট প্রস্তুত রয়েছে। র্যাব সদর দপ্তরে র্যাবের স্পেশাল ফোর্স হেলিকাপ্টারসহ যেকোন পরিস্থিতিতে মোতায়েনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এছাড়াও সার্বিক পরিস্থিতি তদারকির জন্য নির্বাচন সেল এবং কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। শহরে ঢোকা এবং বের হওয়ার সময় তল্লাশি করা হচ্ছে। ২২ জুন পর্যন্ত র্যাবের এ সকল কার্যক্রম বলবৎ থাকবে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্রের ব্যাপারে র্যাবের গোয়েন্দা নজরদারী অব্যাহত রয়েছে এবং আমরা ইতিমধ্যে বেশ কিছু অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করেছি। নির্বাচন কমিশনের বিধিনিষেধ অনুযায়ী নির্বাচন চলাকালে সকল নাগরিককে কোন প্রকার লাইসেন্সধারী অস্ত্র বহন ও প্রদর্শন না করার জন্য কঠোর ভাবে অনুরোধ করা হচ্ছে। নির্বাচন চলাকালীন সময়ে প্রত্যেক নাগরিককে নিজ নিজ জাতীয় পরিচয়পত্র বহন করার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে।’
র্যাব অধিনায়ক জানান, নির্বাচনের দিন নিয়োজিত ম্যাজিস্ট্রেট কোন সহযোগিতা চাইলে র্যাব দ্রুততম সময়ে সাড়া দেবে। সাংবাদিকদের ব্রিফিং শেষে তিনি র্যাব সদস্যদের মহড়া পরিদর্শন করেন। এদিকে রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) নির্বাচনের ভোটকেন্দ্রগুলোতে ৫ স্তরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে পুলিশ। রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) কমিশনার আনিসুর রহমান এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, সব কেন্দ্রগুলোকেই গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাজানো হয়েছে। কোনরকম বিশৃঙ্খলা ঘটতে দেওয়া হবে না।
আজ বুধবার নির্বাচনের ভোট গ্রহণ করা হবে। ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় থাকবেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার পুলিশ সদস্য। এ উপলক্ষে মঙ্গলবার সকালে আরএমপির পুলিশ লাইন্স মাঠে নিরাপত্তা বিষয়ক ব্রিফিং প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেই পুলিশ কমিশনার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
তিনি বলেন, শান্তি-শৃঙ্খলা নিরাপত্তা বজায় রাখার ক্ষেত্রে অতীতের যে কোনো নির্বাচনের চেয়ে এবারের রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচন হবে একটি মডেল স্বরূপ।
ভোটকেন্দ্রে বিশৃঙ্খলা করার কেনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ পুলিশ এখন স্মার্ট পুলিশ। এবারের সিটি নির্বাচনে এর প্রতিফলন ঘটাবে।
এ সময় নির্বাচন পূর্ববর্তী এবং নির্বাচন পরবর্তী সময়ে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতির কথা জানান পুলিশ কমিশনার। তিনি বলেন, ‘১৫৫টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ হবে। এর মধ্যে ১৪৮টি গুরুত্বপূর্ণ এবং ৭টি সাধারণ ভোটকেন্দ্র। আমরা সব কেন্দ্রগুলোকেই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। প্রতিটি কেন্দ্র এলাকায় ৫ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা হয়েছে। নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে আইন-শৃঙ্খলা পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি, র্যাব ও আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবে।’
এ সময় নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর রাজশাহী রেঞ্জের উপ-পরিচালক কামরুন নাহার, নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) বিজয় বসাক, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক অ্যান্ড ডিবি) সামসুন নাহার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।