বিদেশে বাংলাদেশের মিশনের নিজস্ব ভবন হবে। এ জন্য বছরের পর বছর ধরে প্রকল্প তৈরি হচ্ছে, বরাদ্দও রাখা হচ্ছে। তবে পর্যাপ্ত অর্থ ছাড়ের অভাবে কাজ খুব একটা এগোয় না। বর্তমানে ছয় দেশে দূতাবাস ভবনের জন্য সাতটি স্থায়ী কার্যালয়ের কাজ চলছে। এর মধ্যে কোনোটির কাজে প্রায় দেড় যুগ পার হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বিদেশের সরকারের বরাদ্দ দেওয়া জমিও হাতছাড়া হচ্ছে, গুনতে হচ্ছে জরিমানা। এতে যেমন অর্থের অপচয় হচ্ছে, সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছেন কোটি প্রবাসী।পরিকল্পনা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এ ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমরা স্থায়ী ভবন করতে চাই, যাতে দীর্ঘ মেয়াদে খরচ কমে।এর জন্য ক্যাশ দরকার, কিন্তু ক্যাশ তো নেই। ফরেন এক্সচেঞ্জের কারণে অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা ছাড় করছে না।’
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পগুলো আসলেই খুব ধীরগতিতে চলছে। এ বছর এক টাকাও খরচ হয়নি। কয়েকটির মেয়াদ বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র বলেছে, গত অর্থবছরে বিদেশের ৭ প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ১০১ কোটি টাকা। পরে তা কমিয়ে ৯০ কোটি টাকা করা হয়েছে। তবে সেই অর্থ বরাদ্দ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, পাকিস্তানের ইসলামাবাদে ‘বাংলাদেশ চ্যান্সারি কমপ্লেক্সের’ নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০০৭ সালে। ৩ বছর মেয়াদি এই প্রকল্প ১৮ বছরেও শেষ হয়নি। এরই মধ্যে ছয়বার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে, যা ২০২৪ সালের জুনে শেষ হবে। অথচ বিশেষ কারণ ছাড়া উন্নয়ন প্রকল্প দুবারের বেশি সংশোধনী না করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে। ২৯ কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে হয়েছে ৯৭ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ২১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২ কোটি ১০ লাখ টাকা। সে হিসাবে মেয়াদ আবারও বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই।
১০ লাখ প্রবাসীর দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে দূতাবাস ভবন নির্মাণেও এই অবস্থা। প্রথমবার পাওয়া জমি ২০ বছর কাজ না হওয়ায় হাতছাড়া হয়েছে। এখন কূটনৈতিক এলাকায় নতুন জমিতে কাজের প্রস্তুতি চলছে। তবে এখনো প্রকল্প অনুমোদনের প্রাথমিক কাজই শুরু হয়নি। অথচ বর্তমানে ছোট পরিসরের ভবনে সেবা পেতে হিমশিম খেতে হচ্ছে প্রবাসীদের।
অস্ট্রেলিয়ায় ১৯৮৪ সালে চ্যান্সারি ভবন নির্মাণের জন্য পাওয়া জমি ২০ বছর হাতে রেখে জরিমানাসহ ফেরত দিতে হয়েছে ২০০৪ সালে। এ সময়ে জমির লিজ বাবদ খরচ হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। এরপর নতুন করে জমি নিতে হয়েছে। ক্যানবেরায় নতুন নেওয়া ‘বাংলাদেশ চ্যান্সারি ভবন নির্মাণ’ প্রকল্প ২০২১ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৫ সাল পর্যন্ত। ১৪৬ কোটি ৮৭ লাখ টাকার এই প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনো টাকা হাতে পাননি প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। জার্মানিতেও একই পরিণতি হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ২০১৮ সালে বার্লিনে শুরু হয় ‘বাংলাদেশ চ্যান্সারি কমপ্লেক্স নির্মাণকাজ’।
ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০৯ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালে। পরে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সেই সঙ্গে ব্যয়ও ৬০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১৬৯ কোটি টাকা করা হয়েছে। এ পর্যন্ত কাজ হয়েছে ৩ কোটি টাকারও কম।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেন, ‘টাকা না পেলে জার্মানিতে আমরা জায়গা হারাব। আমরা দুই মিলিয়ন ইউরোর মতো খরচ করে ফেলেছি। এখন মাত্র সাড়ে তিন মিলিয়ন ইউরো চাচ্ছি, পাচ্ছি না। কাজ করতে না পারলে জমি হাতছাড়া হবে, আমাদের সুনামও নষ্ট হবে। একবার জমি হাতছাড়া হলে আর এমন জমি পাব না।’
সূত্র আরও বলেছে, সৌদি আরবেও এক দফা জমি হাতছাড়া হয়েছে। দেশটিতে প্রায় ২৫ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি রয়েছেন। সেখানে নেওয়া দুটি প্রকল্পের মেয়াদ প্রায় শেষ। অথচ কাজ কিছুই হয়নি। এর মধ্যে রিয়াদে ‘বাংলাদেশ হাউস (রাষ্ট্রদূত ভবন) নির্মাণ’ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ফেব্রুয়ারিতে। ৩৯ কোটি ২৬ লাখ টাকার এই প্রকল্পে কাজ বলতে কিছুই হয়নি। এ ছাড়া জেদ্দায় ২০৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকার ‘বাংলাদেশ চ্যান্সারি কমপ্লেক্স’ প্রকল্প শুরু হয় ২০১৯ সালে।
মেয়াদ আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। অথচ এটির কাজ কিছুই হয়নি বললে চলে। ব্রুনেইয়ে ‘বাংলাদেশ চ্যান্সারি কমপ্লেক্স ও হাইকমিশনারের বাসভবন নির্মাণ’ প্রকল্পের একই অবস্থা। ২০১৭ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও কাজ হয়নি কিছুই। এরই মধ্যে দুই দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। বাড়তি মেয়াদও শেষ হবে ডিসেম্বরে। ভুটানের থিম্পুতে ‘বাংলাদেশ চ্যান্সারি কমপ্লেক্স এবং রাষ্ট্রদূতের বাসভবন নির্মাণ’ প্রকল্পের মেয়াদ এক দফা বাড়ানোর পর গত জুনে তা শেষ হয়েছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বেশ কয়েক বছর আগে সৌদি সরকার তাদের দেশে মিশন স্থাপনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে যে জমি দেয়, তার পাশেই বাংলাদেশের জন্য সমপরিমাণ জমি দিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ দীর্ঘদিন সেখানে মিশন স্থাপন না করায় ওই ফাঁকা জমিতে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস তাদের গাড়ি পার্কিং করত। পরে একসময় সৌদি সরকারের কাছ থেকে ওই জমি যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে নেয়।
অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দেশে তো আমরা প্রকল্পে ঢিলেমি করছিই। কোনো প্রকল্পই সময়মতো বাস্তবায়ন হয় না। বিদেশের প্রকল্পেও একই হচ্ছে। এতে আমাদের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। প্রবাসীরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব প্রকল্পের কী সমস্যা, তা দেখে দ্রুত সমাধান করা উচিত।’